জায়গিরদারি সংকট

জায়গিরদারি সংকট (Jayagiradari Sankat): Jagirdari Crisis

জায়গিরদারি ব্যবস্থা: ভারতের মুসলমান শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন সময়ে সেনাধ্যক্ষ,আমির-ওমরাহ এবং উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের নগদ অর্থের বদলে নির্দিষ্ট পরিমাণে জমি ভোগ দখল করার অধিকার প্রদান করা হত। এই জমিই জায়গির ও এই ব্যবস্থা জায়গিরদারি ব্যবস্থা নামে ইতিহাসে পরিচিত।

জায়গিরকে কেন্দ্র করে সমস্যা: আকবর যে মনসবদারি ব্যবস্থার পত্তন করেন সেই মনসবদারদের জায়গির দেওয়া হত। কিন্তু পরে এই জায়গিরকে কেন্দ্র করেই এক সংকট ঘনীভূত হয়ে ওঠে। জায়গিরদারদের প্রায়ই অন্য জায়গায় বদলি করা হত। তাই প্রত্যেক জায়গিরদারের লক্ষ্য ছিল যতটা সম্ভব জায়গির লাভ করে তা থেকে যতটা সম্ভব রাজস্ব আদায় করা।

* কৃষকদের প্রতি অত্যাচার: অনেক সময় তারা আবার অন্য ব্যস্তিদের নিজেদের জায়গির ইজারা দিত। ইজারাদাররা চেষ্টা করত সাধ্যমতো অর্থ আদায় করতে। এর ফলে কৃষকরা এত বেশি অত্যাচারিত হত যে তারা চাষবাস ছেড়ে অন্য জায়গায় পালিয়ে যেত। জোগান দেওয়াও সম্ভব হত না।

সম্রাটের ক্ষমতার হ্রাস: সম্রাটের তথা রাষ্ট্রের শক্তি এই কারণে হ্রাস পেতে থাকে। জাহাজারেও শাহজাহানের সময়ে জায়গিরদারদের সংখ্যা বেশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। আবার ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে মনসবদারদের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেলেও সে তুলনায় জমির পরিমাণ বাড়ে নি। তার ওপর সকলেই উর্বর জায়গির পাবার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে।

* জায়গিরদার সম্পর্কে মূল কথা: জায়গিরদারি সংকটের মূল কথা প্রসঙ্গে অধ্যাপক সতীশচন্দ্র মন্তব্য করেছেন যে, শাসকসম্প্রদায়ের সম্পদের চাহিদার তুলনায় তাদের প্রাপ্ত সম্পদের যে ঘাটতি দেখা দিয়েছিল তাই প্রকৃতপক্ষে ছিল জায়গিরদারি সংকট।

জায়গিরদার সংকট ও মোগলদের পতন: সকলেই উচ্চমানের জায়গিরের জন্য রাজদরবারে আবেদন করতে থাকে। ফলে বিভেদের সৃষ্টি হয় ও রাজদরবারে দুর্নীতি ও অনাচার সৃষ্টি হতে থাকে। তাই মোগল সাম্রাজ্যের পতনকে এই জায়গিরদারি সংকট অনেকটাই ত্বরান্বিত করেছিল।

☆ আঞ্চলিক বিদ্রোহ

ঔরঙ্গজেবের অনুদার ধর্মনীতি মোগল সাম্রাজ্যের পতনের একটি বিরাট কারণ। তিনি নিজে ধার্মিক ছিলেন, তাঁর চারিত্রিক সততা ছিল, কিন্তু তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে, ভারতবর্ষ অনেক জাতির সমন্বয়ে গঠিত। এখানে মুসলমানদের সংখ্য অত্যন্ত নগণ্য। গরিষ্ঠ সম্প্রদায়কে শুধু শক্তির জোরে বশে রাখা যায় না। অনুদার ধর্মনীতির ফলে তাই বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়। ঔরঙ্গজেবের পঞ্চাশ বছরের রাজত্বকালে শিখ, রাজপুত, জাঠ, সৎনামী, মারাঠা প্রভৃতি জাতির বিরুদ্ধে তাঁকে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়। ব্যাপক আর্থিক ও সামরিক ক্ষতি মোগল সাম্রাজ্যের পতন ডেকে আনে।

* জাঠ বিদ্রোহ: ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে মথুরার জাঠেরা গোল্লার নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে। গোল্লার বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হলেও জাঠদের ক্রোধ প্রশমন করা সম্ভব হয়নি। বুন্দেলখণ্ডে বুন্দেলরা বিদ্রোহ করে। তাদের নেতা ছিলেন ছত্রশালা। ঔরঙ্গজেব তাঁকেদমন করতে পারেননি।◇ সৎনামী বিদ্রোহ। পাতিয়ালার কাছে সংনামী নামে এক হিন্দু সম্প্রদায় ছিল। তারাও বিদ্রোহ প্রকাশ করলে মোগলবাহিনী সেই বিদ্রোহ দমন করে। শিখ সম্প্রদায় উরল জেবকে প্রচণ্ড বাধা দেয়। তিনি শিখদের নবম গুরু তেগবাহাদুরকে হত্যা করান। তেগবাহাদুরের পুত্র গোবিন্দ সিংহ শিখদের নিয়ে একটি সামরিক বাহিনী গঠন করেন। তাদের ‘খালসা’ বলা হত। খালসাদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল বিধর্মীদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা। শিখজাতি ঔরঙ্গজেবের বিরুখে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও অনমনীয় লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়।

* মারাঠা ও রাজপুত বিদ্রোহ: উরদ্দজেবের বিরুদ্ধে মারবাড় ও মেবার রাজ্যও যুখে অবতীর্ণ হয়। মেবারের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করা সম্ভব হলেও মারবাড় সম্রাটের বিরুধে যুখ চালিয়ে যেতে থাকে। দাক্ষিণাত্যের প্রবল মারাঠাদেরও পরাজিত করতে ঔরঙ্গ জেবকে বেশ বেগ পেতে হয়। শেষে তিনি ব্যর্থতার শিকার হন। এই মারাঠারাই পরবর্তীকালে মোগল সাম্রাজ্যের ভিতকে দুর্বল করে দিয়েছিল।

বাংলার স্বাধীনতা: ঔরঙ্গজেব ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করত বাংলার সুবাদারমুরশিদকুলি খাঁ স্বাধীনভাবে বাংলা সুবার শাসনভার তুলে নেন। দোয়াব অঞ্চলও স্বাধীনতা ঘোষণা করে। আফগানেরা রোহিলাখণ্ডে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে থাকে। সাদাত খাঁও অযোধ্যা প্রদেশে স্বাধীনভাবে রাজত্ব স্থাপন করেন। নিজাম-উল-মূলক্ নামে দাক্ষিণাত্যের সুবাদার হলেও কার্যত তিনি স্বাধীনভাবে হায়দ্রাবাদেই রাজত্ব করতে থাকেন। মহীশূরেও একটি হিন্দুরাজ্য গড়ে ওঠে।

☆ মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ

ঔরঙ্গজেবের সময় ভারতজোড়া যে বিশাল সাম্রাজ্য ছিল, তাঁর মৃত্যুর মাত্র প্যাশ বছরের মধ্যে তা কেবল দিল্লি ও তার আশেপাশের কয়েকটি অঞ্চলের মধ্যে সীমাবন্ধ হয়ে পড়ে। ঔরঙ্গজেব তাঁর জীবদ্দশায় এই বিশাল সাম্রাজ্যের পতনের অশনি সংকেত দেখে গিয়েছিলেন এবং মৃত্যুশয্যায় তাঁর পুত্র আজমকে তিনি সেকথা লিখেও গেছেন।

ঔরঙ্গজেবের দায়িত্ব: ঔরঙ্গজেব বোধহয় জানতেন না যে, এই পতনের মূলে তাঁর দায়িত্ব অনেকখানি। তাঁর ধর্মান্ধ দৃষ্টিভঙ্গি, রাজপুত ও দাক্ষিণাত্য নীতি মোগল সাম্রাজ্যের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করেছিল। সাম্রাজ্যের সমস্ত ক্ষমতা তিনি নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করেছিলেন। একাকী সেই বিশাল সাম্রাজ্য শাসনের সময় ও সামর্থ্য তাঁর ছিল না। ফলে তাঁর রাজত্বের শেষদিকে সাম্রাজ্যের চারদিকে বিশৃঙ্খলা ও বিদ্রোহ দমন সম্ভব ছিল না।

* কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতা: ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর কেন্দ্রীয় শাসন একেবারেই দুর্বল হয়ে পড়ে। সেই সুযোগে প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ একে একে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সাম্রাজ্যের ইতস্তত রাজপুত, শিখ, মারাঠা জাতির অভ্যুদয়ের ফলে মোগল সাম্রাজ্যের শক্তি হ্রাস পায়।

যাস্ত রাজপুত নীতি: মোগল শাসনব্যকথা মূলত ছিল স্বৈরতান্ত্রিক। সেই শাসনব্যবস্থায়, সম্রাটের সঙ্গে প্রজাসাধারণের কোনো যোগ ছিল না। মাঝখান থেকে আমির-ওমরাহ ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মচারীগণ যথেষ্ট ক্ষমতা ভোগ করতেন। মোগল সম্রাটগণের মধ্যে একমাত্র আকবর প্রজাগণের হৃদয় জয় করেছিলেন। কিন্তু তাঁর উত্তরসূরী ঔরঙ্গজেবের গোঁড়ামি ও ধর্মীয় নীতির ফলে চারদিকে বিদ্রোহ ও অসন্তোষের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। যে হিন্দু রাজপুতগণ একদা মোগল সাম্রাজ্যের স্বস্তস্বরূপ ছিলেন, তাঁরাই শেষ পর্যন্ত মোগলদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করলে মোগল সাম্রাজ্যের ভিত দুর্বলহয়ে পড়ে।

আমির ও ওমরাহগণের ভোগবিলাস ও যথেচ্ছচার: আমির-ওমরাহগণ যথেচ্ছাচার ও ভোগবিলাসে লিপ্ত থাকার ফলে রাজকার্যে আলস্য দেখাতে শুরু করেন। রাজধানীতে সম্রাটের দীর্ঘ অনুপস্থিতি তাঁদের এই যথেচ্ছাচার, ভোগবিলাস ও দুর্নীর্তিকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ফলে একদা মোগল সাম্রাজ্যের দৃঢ়সংকধ শাসনব্যবস্থা শিথিল হয়ে এর পতনকে ত্বরান্বিত করে।

অভিজাত শ্রেণির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা: ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোগল দরবারেঅভিজাত শ্রেণির তিনটি গোষ্ঠীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলি হল হিন্দুস্থানী গোষ্ঠী,ইরানি গোষ্ঠী এবং তুরানি গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীভুক্ত দলের নেতারা সাম্রাজ্যের স্বার্থ বিসর্জনদিয়ে রাজদরবারে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা এবং ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির দিকেইবেশি মনোযোগী ছিলেন। মোগল সম্রাটগণ এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব দমন করার পরিবর্তে একেউস্কানি দিয়ে, এমন কী কোনো কোনো গোষ্ঠীর নেতাদের সাহায্য নিয়ে নিজেদের অস্তিত্ববজায় রাখতেন।

আঞ্চলিক শন্তির সক্রিয়তা: অচিরেই গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে দীর্ণ মোগল রাজনীতির দুর্বলতা প্রকট হয়। সেই সুযোগে আঞ্চলিক শক্তিগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, সৈয়দ ভ্রাতৃবৃন্দ নিজাম-উল্-মুলক প্রভৃতি অভিজাতগণের সাম্রাজ্য স্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপের উল্লেখ করা যায়, যাঁরা রাষ্ট্রিক ঐক্য রক্ষার পরিবর্তে আঞ্চলিক ক্ষমতা জোরদার করতেতৎপর ছিলেন।

বিদেশি আক্রমণকারীদের পথ প্রশস্ত: বস্তুতপক্ষে এই অভিজাতদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ক্ষমতার লড়াই সাম্রাজ্যের সংহতিকে বিনষ্ট করে, বিচ্ছিন্নবাদী শক্তিগুলিকে উৎসাহ দান করে এবং বিদেশি আক্রমণকারীদের ভারত আক্রমণের পথ প্রশস্ত করেছিল।

ভ্রান্ত রাজস্বনীতি: মোগল সাম্রাজ্যের পতনের আর একটি অন্যতম কারণ ছিল মোগল সম্রাটগণের ভ্রান্ত রাজস্ব নীতি। মোগল রাজস্বের প্রধান উৎস ছিল ভূমিরাজস্ব। কিন্তু জায়গিরপ্রথা প্রচলিত থাকায় সম্রাটগণকে রাজস্বের ব্যাপারে জায়গিরদারদের ওপর নির্ভর করতে হত। তাঁরা সবসময় ঠিকমতো রাজস্ব আদায় করতেন না, বা করলেও সম্রাটের রাজস্ব ঠিকমতো পরিশোধ করতেন না। ফলে মাঝে মাঝেই দেখা দিত দারুণ অর্থনৈতিক সংকট।

অর্থনৈতিক সংকট: মোগল সাম্রাজ্যের শেষদিকে সাম্রাজ্যের অনেক স্থানে মারাঠাদের হামলার ফলে মোগলদের রাজস্ব আদায় ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এদিকে ক্রমাগত যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলে অর্থভাণ্ডারে টান পড়ে; অথচ ঠিকমতো রাজস্ব আদায় না হওয়ার ফলে সম্রাটদের দারুণ অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে পড়তে হয়েছিল। এই সঙ্কটের মোকাবিলায় পরবর্তী মোগল সম্রাটগণ ইজারাদারির পত্তন করেছিলেন।

* প্রজাপীড়ন: ইজারাদারি ব্যবস্থায় জমি নীলামে দিয়ে সর্বোচ্চ দাম যারা দিতে পারত তাদের জমি দেওয়া হত। তাদের অত্যাচারে অনেক সময় প্রজারা ঋণ পরিশোধ না করতে পারলে তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হত। অনেক সময় প্রজারা ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়েও যেতেন। এতে সামগ্রিকভাবে দেশে কৃষি উৎপাদন কমে যায়। ইতস্তত প্রজাগণ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

ইউরোপীয় বণিকদের আগমন: বাণিজ্য শুদ্ধ থেকে সম্রাটদের যে আয় হত, ইউরোপীয় বণিকদের আগমনের ফলে তাও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। নিদারুণ অর্থসঙ্কটের মুখোমুখি হয়ে সম্রাটগণ শেষপর্যন্ত দিশেহারা হয়ে পড়ে।

সম্রাটদের ক্ষমতা লোগঃ যে কোনো দেশ বা রাজ্যের শাস্তি ও সমৃদ্ধি নির্ভর করে আর্থিক সমৃদ্ধির ওপর। মোগল সাম্রাজ্যের শেষের দিকে সেই সমৃদ্ধি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সম্রাটগণের ক্ষমতা হ্রাস পায়। স্বাভাবিকভাবে তাঁরা প্রথমে প্রাদেশিক শাসনকর্তা এবং পরে ইংরেজ কর্তৃপক্ষের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এতে তাঁদের দুর্বলতা প্রকট হয়ে পড়ে ও সাম্রাজ্য ছিন্নভিন্ন হতে থাকে।

পরবর্তী বংশধরগণের দুর্বলতা: মোগল বংশধরগণের দুর্বলতাও সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ। ঔরঙ্গজেবের পর এমন কোনো সম্রাট অভিষিক্ত হননি, যিনি শক্তহাতে ক্ষয়িষু সাম্রাজ্যের হাল ধরতে পারেন। পরন্তু তাঁরা ছিলেন বিলাসী, অকর্মণ্য ও অস্থিরচিত্ত। ফলে তাঁরাও মোগল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার দরুণ বিশাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা দুরূহ কাজ ছিল। ফলে স্থানে স্থানে বিদ্রোহ দেখা দিলে সে বিদ্রোহ দমনে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব ছিল না। এতেও সাম্রাজ্যের প্রভূত ক্ষতি হয়।

সামরিক সংগঠনের দুর্বলতা: মোগলদের সামরিক সংগঠনও এই সাম্রাজ্যের পতনের জন্য অনেকখানি দায়ী। মনসবদারী প্রথা প্রবর্তনের ফলে সম্রাটকে সৈন্য সরবরাহের জন্য মনসবদারের ওপর নির্ভর করতে হত। কিন্তু মনসবদারগণ নিজেরাই শৃঙ্খলাপরায়ণ ও ঐক্যকধ ছিলেন না। ফলে যুদ্ধের সময় সম্রাটকে বিপদে পড়তে হত। আকবর, ঔরঙ্গজেবের আমলে আবদুর রহিম খান, ইসলাম খান, মুজাফফর খান, মহাব্বত খান প্রমুখ যোগ্যতাসম্পন্ন মনসবদারদের নাম পাওয়া যায়; কিন্তু পরবর্তী মোগল সম্রাটগণের আমলে তেমন কোনো যোগ্য মনসবদারের নাম পাওয়া যায় না। তাছাড়া সেনাবাহিনীতে নানারূপ ভোগবিলাস ও দুর্নীতি প্রবেশ করার ফলে সেনাদের মনোবলও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

রণনীতির ব্যর্থতা: মোগলদের রণকৌশল ছিল গতানুগতিক। সেনাবাহিনী বিশাল হলেও প্রয়োজনীয় রণকৌশল ও সামরিক উপকরণের অভাবে অনেক সময় মোগল সম্রাটদের পরাজয় বরণ করতে হত। উদাহরণস্বরূপ, শিবাজি বা রাজপুতদের রণকৌশলের উল্লেখ করা যায়। বিশাল মোগল বাহিনী রাজপুতদের রণকৌশল ও ক্ষিপ্রগতি মারাঠাদের গেরিলা যুদ্ধের কাছে বারাবার হার মেনেছিল। এছাড়া ছিল গোলা, বারুদ, কামান প্রভৃতি আধুনিক সমরাস্ত্রের অভাব। এ কারণে বিদেশি কামানের বিরুদ্ধে কোনোদিন মোগল বাহিনী দাঁড়াতে পারেনি। মোগল সেনাবাহিনীতে কোনো নৌবাহিনী ছিল না। ফলে মোগল সাম্রাজ্যের সন্নিহিত উপকূল এবং বাণিজ্য পথগুলি একরকম অরক্ষিতই ছিল।

অত্যধিক ব্যয়বহুল জীবনযাত্রা: মোগল সম্রাটগণের অমিতব্যয়িতা ও ভোগবিলাসও সাম্রাজ্যের পতন ডেকে আনে। শাজাহান তাঁর রাজসভায় জাঁকজমক ও স্মৃতিসৌধ ইত্যাদি নির্মাণের জন্যে অকাতরে অর্থব্যয় করার ফলে সাম্রাজ্যে তীব্র অর্থসঙ্কট সৃষ্টি হয়। প্রজাদের শোষণ করে অর্থ আদায় করতে গেলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ঔরঙ্গজেব নিজে মিতব্যয়ী ছিলেন। কিন্তু তিনিও অবিরাম যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকার জন্য রাজকোষ প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে অথচ রাজস্ব আদায়ের সেরূপ যোগ্য ব্যবস্থা ছিল না, যাতে শূন্য রাজকোষ আবার পূর্ণ হয়। সাম্রাজ্যব্যাপী সেই অর্থসঙ্কটও মোগল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণরূপে বিবেচিত হয়।

নাদির শাহের ভারত আক্রমণ: মোগল সাম্রাজ্যের পতনের সর্বশেষ কারণটি হল বৈদেশিক আক্রমণ। পারস্যের শাহ কর্তৃক কান্দাহার অধিকৃত হলে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল অরক্ষিত হয়ে পড়ে। এই পথ ধরে পারস্যের নাদির শাহ এবং আফগান নেতা আহম্মদ শাহ আবদালি ভারতে ঢুকে অবাধে হত্যা ও লুণ্ঠন চালাতে থাকে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে নাদির শাহের ভারত আক্রমণ।

* নাদির শাহের অরাজকতা: নাদির শাহ অবাধে কাবুল ও পাঞ্জাব জয় করে দিল্লিতে ঢুকে পড়েন। তারপর দিল্লিশ্বর মহম্মদ শাহকে যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দি করে অবাধে নিরীহ প্রজাদের হত্যা ও লুণ্ঠন চালাতে থাকে। শেষপর্যন্ত তিনি বহু কোটি স্বর্ণমুদ্রা, বিপুল পরিমাণ মণিমাণিক্য নিয়ে পারস্যে পলায়ন করেন। যাবার আগে দিল্লিকে শ্মশানে পরিণত করে যান। পরবর্তী দুর্বল সম্রাটগণের পক্ষে আর সম্ভব হয়নি সাম্রাজ্যের শাস্তি ও সুস্থিতি ফিরিয়ে আনা। ফলে বিশাল মোগল সাম্রাজ্য কালের নিয়ম মেনে পতনকে মেনে নেয় এবং মোগল সাম্রাজ্যের অবক্ষয় সম্পূর্ণ হয়।