সুলতানি ও আমলে ভক্তি আন্দোলন

☆ সুলতানি ও আমলে ভক্তি আন্দোলন (Sulatani O Amale Bhakti Andolan): Bhakti movement during the Sultanate and period.

ভারতে খ্রিস্টীয় পনেরো ও ষোলো শতকে যে ধর্মসংস্কার আন্দোলন পরিলক্ষিত হয়েছিল, ইসলাম ধর্মের গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে হিন্দুধর্মে যে উদারনৈতিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ইতিহাসে তা ভক্তিবাদ, আন্দোলন নামে সম্যক পরিচিতি লাভ করে।

* ভক্তিবাদের মূল কথা: ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যই ছিল ভক্তিবাদের আদর্শ। হিন্দুশাস্ত্রেআত্মার মুক্তির জন্য জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি-এই তিনটি বিশেষ গুণের উল্লেখ আছে। আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার অতীন্দ্রিয় মিলনই ছিল ভক্তিবাদের মূল কথা। খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে দক্ষিণ ভারতে শৈব নায়নার এবং বৈয়ব আলবারগণ জৈন ও বৌদ্ধদের কঠোরতার বিরুদ্ধে ঈশ্বরের প্রতি অবিচল ভত্তিকেই জীবনের মুক্তির একমাত্র পথ বলে প্রচার করেন।

* সামাজিক-ধর্মীয় আন্দোলন: বর্ণবিভাগের কঠোরতা তাঁরা মানতেন না। স্থানীয়ভাষায় তাঁরা নানাস্থানে ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও ভক্তির বাণী প্রচার করতেন। প্রচারের মাধ্যমে তাঁরা সামাজিক কুসংস্কার ও দুর্নীতি দূরীভূত করার ক্ষেত্রে সর্বশন্তি প্রয়োগ করেন। তাই এক সামাজিক-ধর্মীয় আন্দোলন বলে ভক্তিবাদকে চিহ্নিত করা যায়।

* ভক্তিবাদের প্রধান উদ্দেশ্য: ভক্তিবাদের প্রচারকরা কোনো শাস্ত্রীয় আচারবিধি পালন করতেন না। জাতিভেদ এবং অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে তাঁরা মতবাদ প্রচার করতেন। তাঁদের মতে, আল্লাহ, হরি, কৃয় যে নামেই ঈশ্বরকে আরাধনা করা হোক না কেন, ঈশ্বর এক এবং অভিন্ন। ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি নিবেদন করা এবং মানুষের প্রতি প্রেম ও ভালোবাসা প্রদর্শন করাই ভক্তিবাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।

☆ কয়েকজন ভক্তিসাধক ও তাঁদের বাণী

নামদেব (১২৭০-১৩৫০ খ্রি.): ভক্তিসাধকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পুরুষ হলেন নামদেব। তিনি চোদ্দো শতকে মহারাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেন। অনেকের মতে তাঁর বৃত্তি ছিল ‘দরজি’র। তিনি মূর্তিপুজা ও বাহ্যিক আড়ম্বরে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর মতে, ঈশ্বরে ভক্তি এবং সর্বজীবে প্রেমই হল ঈশ্বরপ্রাপ্তির একমাত্র মার্গ।

রামানন্দ (১৪০০-১৪৪৭ খ্রি.): চোদ্দো শতকের এক বৈয়ব ধর্ম প্রচারক হলেন রামানন্দ। রামচন্দ্রের ভক্ত রামানর নিজে ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করলেও সমাজের জাতিভেদ প্রথাকে তিনি অস্বীকার নিরতেন। শ্রীরামচন্দ্রই ঈশ্বর-তার প্রতি অবিচল ভত্তিই মানুষকে মুক্তির পথ দেখাবে’-এই ছিল রামানন্দের বাণী। সহজ, সরল হিন্দি ভাষায় তিনি ঈশ্বরের ভরি কথা প্রচার করতেন। হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বহু মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে ভক্ত কবির এবং রুইদাস বিখ্যাত ছিলেন।

কবির (১৪৪১-১৫১৮ খ্রি.): মধ্যযুগে ভারতে ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম সঠিক সাধক ছিলেন কবির। তিনি রামানন্দের শিষ্য হন। তিনি হিন্দু ও মুসলমান ধর্মের কোনটারই বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান মানতেন না। জাতিভেদ, মূর্তিপূজা, নামাজ, রোজার তীব্র বিরোধী ছিলেন। তার মতে ঈশ্বর এক ও অভিন্ন।

কবিরের উপদেশ: কবির প্রচার করেছিলেন সব ধর্মই এক। তার মতে হিন্দুদের রামই মুসলিমদের রহিম। মানুষে মানুষে কোনো প্রভেদ নেই। তিনিই প্রথম হিন্দু ও মুসলিমদের মধে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেন। কবির তার উপদেশগুলি দোঁহার মাধ্যমে প্রচার করেন। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকই তার শিষ্য হন।

নানক (১৪৬৯-১৫৬৮ খ্রি.): লাহোরের তালবন্দি গ্রামে ক্ষেত্রীবংশের এক ব্যবসায়ীর ঘরে নানকের জন্ম হয়। অত্যন্ত অল্প বয়সেই তিনি গৃহত্যাগী হন। সন্ন্যাসীর বেশে তিনি ভারতের বিভিন্ন স্থানে এমনকি মাও বাগদাদও পরিভ্রমণ করেন। তিনি বহু স্তবগান রুন করেন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ পার্শ্বচর মর্দানা তারের যত্র সুর দিয়ে বাজাতেন ও নানক গান গাইতেন।

* নানকের ধর্মমত: কবিরের মতো নানক একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর ধর্মমত ছিল একেশ্বরবাদ, গুরু ও নামজপ। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান মূর্তিপূজা এবং জাতিভেদ নানক মানতেন না। নই পুরু নানক কোনো ধর্মমত প্রবর্তন না করে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিভের দূর করাই ছিল ওর প্রধান উদ্দেশ্য। তাঁর শিষ্যরা ‘শিখ’ নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর উপদেশাবলি সংকলন করে পরবর্তী কালে ‘গ্রন্থসাহেব’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় যা শিখদের ধর্মগ্রন্থ নামে পরিচিত।

শ্রীচৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩ খ্রি.): ভক্তিবাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রবস্তা ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব। বাংলাদেশের নদিয়ায় এক শিক্ষিত ব্রাহ্মণ বংশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন জগন্নাথ মিশ্র ও মাতা শচীদেবী। তাঁর শৈশব-কৈশোরের নামগুলি ছিল বিশ্বস্তর, নিমাই, গৌর। সন্ন্যাস নেবার পর তাঁর নাম হয় শ্রীকৃরচৈতন্য।

শিক্ষা ও দীক্ষা: বাল্যকালেই তিনি নানা শাস্ত্রে পণ্ডিত হয়ে ওঠেন। বৈষুবগুরু ঈশ্বরপুরীর কাছে কুয়মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করে তিনি নানা স্থানে পরিভ্রমণ করে কৃল্পনাম বিতরণ করেন। তাঁর শেষ জীবন পুরীধামে অতিবাহিত হয়। তিনি প্রচার করেন যে, বৈরাগ্য ও কৃয়ের প্রতি অবিচল ভত্তিই জীবের মুক্তি আনয়ন করে।

* শ্রীচৈতন্যদেব প্রচারিত মতবাদ: শ্রীচৈতন্যদেবের প্রচারিত মতবাদের তিনটি মূল কথা হল-জীবে প্রেম, ঈশ্বরে ঐকান্তিক ভক্তি ও সেই ভক্তিভাব জাগরিত করার জন্য নাম সংকীর্তন। তিনি জাতিভেদ মানতেন না। আদ্বিজচণ্ডালকে তিনি তাঁর ইষ্টনাম অকাতরে ও অযাচিতভাবেবিতরণ করে গেছেন।

* সমান অধিকারের বাণী: জাতি-ধর্ম ভেদাভেদ অতিক্রম করে সকল মানুষের সমানাধিকারের বাণীই তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হত। যবন হরিদাস ছিলেন তাঁর অন্যতম শিষ্য। তাঁর অন্যান্য শিষ্যদের মধ্যে ওড়িশার রাজা প্রতাপরুদ্রদেব, শ্রীরাম, রূপ, সনাতন এবং আরও অনেকে উল্লেখযোগ্য। তাঁর প্রচারিত ধর্মমত ‘গৌড়ীয় বৈয়বধর্ম’ নামে পরিচিতি লাভ করে। বাঙালি জাতির ওপর তাঁর ভক্তিবাদের প্রভাব ‘বাঙালি জাতির প্রথম জাগরণ’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। অনেকে তাঁকে শ্রীকৃয়ের অবতার বলে পূজা করে থাকেন।

মীরাবাই: ভক্তিবাদের অপর স্মরণীয় প্রবস্তা হলেন মীরাবাই। রাজপুতানার মেবার রাজপরিবারের কুলবধূ মীরাবাই গানের বা ভজনের মধ্য দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করতেন। এ প্রসঙ্গে কর্নেল টড মন্তব্য করেছেন যে, মীরাবাই ছিলেন রাণা রতন সিংহের কন্যা এবং ১৪১৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম হয়। অবশ্য ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, খুব সম্ভবত ১৪২০ খ্রিস্টাব্দে মীরাবাই জন্মগ্রহণ করেন। রাজপ্রাসাদের বিলাস-বৈভব অ্যাগ করে সন্ন্যাসিনী মীরাবাই মথুরা ও বৃন্দাবনে সাধুসঙ্গে জীবন অতিবাহিত করেন।

দাদু দয়াল (১৫৪৪-১৬০৩ খ্রি.): কথিত আছে দাদু দয়াল আমেদাবাদে একটি মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর পালক পিতা ছিলেন লোদিরাম নামে একজন ধুনুরি। আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি ছিলেন ধর্মান্তরিত মুসলমান। তাঁর জীবনের বেশির ভাগটাই রাজস্থানে কেটেছিল।

* দাদু দয়ালের মতামত: শোনা যায়, আকবরের সঙ্গে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে দাদু দয়ালের সাক্ষাৎ হয়। দাদুর মতবাদ ছিল, ‘আমি হিন্দু হতে চাই না, মুসলমান হতে চাই না, আমি চাই দয়াময়কে। তিনি বলেছিলেন, ঈশ্বরের রাজ্যে হিন্দু মন্দির বা মুসলমান মসজিদ নেই, যেখানে ঈশ্বর বিরাজিত সেখানে সম্প্রদায় বা সাম্প্রদায়িকতা থাকতে পারে না। দাদু কবিরের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।

তুলসীদাস (১৫৩২-১৬২৩ খ্রি.): তুলসীদাসের খ্যাতি হিন্দিতে লেখা রামের জীবনকাহিনি বা রামায়ণকে কেন্দ্র করে ‘রামচরিতমানস’-এর জন্য। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। কথিত আছে, তিনি একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ‘রামচরিতমানস’-এর মাধ্যমে তিনি নৈতিকতা, প্রেম ও ভত্তির আদর্শ প্রচার করেছেন এবং সনাতন হিন্দুধর্মের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেছেন।

অন্যান্য সাধক: এঁরা ছাড়াও ভক্তি আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল আরো বহু মনীষীর। উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারতে সুরদান (১৪৮৩-১৫৬৩), শঙ্করদেব (১৪৬৩-১৫৬৮) প্রমুখ এবং দক্ষিণ ভারতে রামানুজ (একাদশ শতক), মাধবাচার্য (ত্রয়োদশ শতক), নিম্বার্ক (ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতক), বল্লভাচার্য (পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতক)। এছাড়াও কবিরের সমসাময়িক রুইদাস, দাদু দয়ালের শিষ্য সুন্দরদাস এবং কবিরের শিষ্য ধরণীদাসের কথাও জানা যায়।

ভারতীয় সমাজে ভক্তি আন্দোলনের প্রভাব বা ফলাফল:

সুলতানী আমলের শেষ পর্বে হিন্দুধর্মে যে সমন্বয়বাদী ধর্ম আন্দোলনের সূচনা হয় তা ভত্তি আন্দোলন নামে পরিচিত। এই আন্দোলন প্রথমে দক্ষিণ ভারতে পরে উত্তর ভারতে প্রসার লাভ করে। ভত্তি আন্দোলনের প্রধান প্রবস্তা হলেন-কবির, রামানন্দ, নামদের ও শ্রীচৈতন্য।

তাঁদের মতে ঈশ্বর এক ও অভিন্ন। যে কোন লোকই ভত্তির মাধ্যমে ভগবানের কাছে আসতে পারে।ভত্তি আন্দোলন একটি বহুল প্রচারিত আন্দোলন যা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল।

এই আন্দোলন মানুষের মনে ঔৎসুকের সৃষ্টি করেছিল। বৌদ্দঘর্ম পতনের পর আর কোনো ধর্মীয় আন্দোলন ভারতবর্ষে ভত্তি আন্দোলনের মত্রে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি।

* (ক) হিন্দু সমাজের সংহতি ও ঐক্য রক্ষা: ভক্তি আন্দোলনের সাধকরা যেমন হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাদের মতামত ব্যস্ত করে নিজেদের নিয়োজিত করেছিল তেমনি অন্য দিকে ভত্তি আখোলনের ফলে হিন্দু সমাজের সংহতি ও ঐক্য রক্ষা পেয়েছিল।

(খ) সহজ সরল জীবন যাত্রা: ভক্তি আন্দোলনের উদারতা ও মানসিকতা হিন্দু সমাজের নীচু স্তরের মানুষের মন জয় করে মানুষকে সহজ সরল জীবন যাত্রার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে।

◇ (গ) হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সমন্বয় সাধন: ভক্তি আন্দোলনের প্রভাবে হিন্দু ও মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছুটা সমন্বয় সাধিত হয়। অবশ্য মুসলিম জীবন সুলতানগণ প্রায় সকলেই ছিলেন ধর্মান্ধ।

* (ঘ) সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ: ভক্তি আন্দোলনের ফলে সাহিত্যও সংস্কৃতিরক্ষেত্রে বিকাশ ঘটেছিল। বহু আঞ্চলিক ভাষার সাহিত্য চর্চাও শুরু হয়েছিল।

* (৫) জাতিভেদ প্রথা অবসানের চেষ্টা: ভক্তি আন্দোলনে সাধু সন্তরা জাতিভেদ প্রথার পরিবর্তনে ব্যর্থ হলেও কর্ণভেদ প্রথার কঠোরতা হ্রাসে কিছুটা সফলতা অর্জন করেছিল।

◇ (চ) নারীদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি: ভক্তি আন্দোলনের ফলে মধ্যযুগীয় নারীরা ধর্মীয় ও সামাজিক স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করে।

* (ছ) রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব: ভত্তি আন্দোলনের ফলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব পড়ে। জ্ঞানদীপ্ত মানবতাবাদের নীতি মেনে শাসকরা জনকল্যাণের আদর্শ গ্রহণ করেন।