সুলতানি ও মোগল আমলে চিত্রকলা

সুলতানি ও মোগল আমলে চিত্রকলা (Sulatani O Mogal Amale Citrakala): Painting during the Sultanate and Mughal period.

* চিত্রে পারসিক রীতি: হিন্দু-মুসলিম সভ্যতা সুদীর্ঘকাল ধরে পাশাপাশি সহাবস্থানকরার ফলে উভয়ের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একে অপরকে প্রভাবিত করে। চিত্রকলার ক্ষেত্রে পারসিক রীতির প্রভাব সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হত। চিত্রের বিষয়বস্তুতে থাকত সাধারণ জনজীবন এবং হিন্দু পৌরাণিক উপাখ্যান থেকে গৃহীত বিষয় অথচ তা অঙ্কন করা হত পারসিক রীতিতে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের পটচিত্রও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

চিত্রাঙ্কনে পৃষ্ঠপোষকতা: সুলতানি যুগে বৃহৎ পরিসরে চিত্রাঙ্কন করা হত এবং ক্ষুদ্রচিত্র অঙ্কন পদ্ধতির তখন এতটা কদর ছিল না। সুলতানি যুগের সংগৃহীত কিছু কিছু গ্রন্থে ইরাকি বা পারসিক ব্যাখ্যা চিত্র পাওয়া গেলেও, সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এদেশে তখন ক্ষুদ্র চিত্র অঙ্কন বিষয়টি ততটা সমাদর লাভ করতে পারেনি। আবার মোগল আমলে ছোটো চিত্রাঙ্কন এবং গ্রন্থচিত্রের অঙ্কন দুটিই সমান গুরুত্ব লাভ করে। শিল্পীর কল্পনা ও বাদশাহের ইচ্ছা অনুযায়ী মোগল চিত্রকলায় কখনও আঙ্গিক, কখনও চিত্রের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য প্রাধান্য পেয়েছে। যুখ-অভিযান, দরবারি রাজনীতির সঙ্গে নৈসর্গিক প্রাকৃতিক চিত্র অথবা রামায়ণ ও মহাভারত প্রভৃতি মহাকাব্যের কাহিনিওতার মধ্যে স্থান পেয়েছে।

হিন্দু চিত্রশিল্পী: আকবর সর্বধর্মসমন্বয়ের পক্ষপাতী ছিলেন। মির সৈয়দ আলি এবং আবদুস সামাদের ‘হামজানামা‘ শীর্ষক অ্যালবামে ‘তানসেনের আগমন‘ চিত্রটিতে পারসিক প্রভাবের বদলে মোগল ও হিন্দু ধারার অপূর্ব সংযোগ দেখা গেছে। আকবরের সময়ে চিত্রকরদের মধ্যে হিন্দু চিত্রকরেরাই ছিলেন প্রধান। হিন্দু চিত্রশিল্পীদের মধ্যে যশবন্ত, কেশব, মুকুল, মহেশ এবং আরো অনেকে উল্লেখযোগ্য ছিলেন। আবুল ফজল সেই সময়ে যে সতেরো জন অগ্রণী শিল্পীর নাম উল্লেখ করেছেন, তাদের মধ্যে অন্তত তেরোজন ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী।

* চিত্রকলার চরম উৎকর্ষতা: মোগল চিত্রকলা চরম উৎকর্ষতা লাভ করে জাহাঙ্গিরের সময়ে। মোগল চিত্ররীতিকে পারসিক প্রভাব থেকে মুক্ত করে ভারতীয়করণ করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সফলকামী ব্যক্তিত্ব। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মোগল চিত্রকলার গৌরব স্তিমিত হয়ে যায়। এইভাবে দেখা যায় যে, চিত্রকলা মোগল যুগেই পারসিক ও ভারতীয় রীতির সংযোগে এক স্বতন্ত্র চিত্রশৈলীরূপে প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক এডওয়ার্ডস ও গ্যারেট উল্লেখ করেছেন যে, মোগল যুগে চিত্রকলা পারসিক ও হিন্দু ভাবধারার সম্মিলিত রূপ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।

☆ সুলতানি ও মোগল আমলে স্থাপত্য শিল্প

সুলতানি যুগের স্থাপত্যশিল্পে হিন্দু ও মুসলিমদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও প্রীতির সুফল প্রকাশিত হয়। হিন্দু ও ইসলামীয় স্থাপত্য শিল্পের এক অভূতপূর্ব মিশ্রণ ওই যুগে প্রকটিত হতে দেখা যায়।

স্থাপত্য শিল্পে মিশ্রণ: ঐতিহাসিক ফার্গুসনের মতে, এই মিশ্রণের কারণ ছিল সুলতান, প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও অভিজাতবর্গ নির্মাণকার্যে হিন্দু শিল্পীদের নিযুক্ত করতেন। আবার অনেকে মনে করেছেন যে, এই সংমিশ্রণের মূলে নিহিত থাকা অন্য কারণ হল-সুলতানি আক্রমণের সময়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত জৈন ও হিন্দু মন্দিরের ভগ্ন অংশগুলিকে সেই সময়ের স্থাপত্যকার্যে ব্যবহার করা হত। তাছাড়া হিন্দু ও ইসলামি স্থাপত্যের আলংকারিক কারুকার্যের মধ্যে যথেষ্ট মিল দেখা যেত।

মসজিদ-মন্দির নির্মাণের রীতি: স্যার জন মার্শাল মন্তব্য করেছেন যে, হিন্দু মন্দির ও মুসলমান মসজিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল উন্মুক্ত অঙ্গনের চারপাশে সারি সারি স্তম্ভ নির্মাণ। সুতরাং যেসব মন্দিরে এই সকল বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হত সেগুলিকেই স্বাভাবিক ভাবে মসজিদে পরিণত করা হয়েছিল। হিন্দুরীতির অলংকরণ সাধারণ ইসলামীয় রীতিকে অবশ্যই আকৃষ্ট করত।

স্থাপত্যের ধরন: সুলতানি যুগের স্থাপত্যের দুটি ধরন দেখা যায়-দিল্লির ধরন এবং প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক ধরন। দিল্লি ও তার নিকটবর্তী যে সব স্থাপত্যকীর্তি নির্মিত হত, সেগুলির শৈলীতে এমন কতকগুলি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হত যা প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক স্থাপত্যে উপস্থিত ছিল না। প্রাসাদগুলিতে প্রচুর খিলান ও গম্বুজ ব্যবহার করা হত।

* স্থাপত্যে কারুকার্য ও অলংকরণ: খিলানগুলিতে সূক্ষ্ম কারুকার্য করা থাকত। সেগুলিতে ফুলের সর্পিল অলংকরণ ও কোরানের বাণী উৎকীর্ণ করা থাকত। তাছাড়া প্রাসাদগুলিতে চুন, বালি ও জলের মিশ্রণে এক ধরনের ‘আস্তর’ ব্যবহার করা হত। আবার প্রাসাদের অলংকরণে স্বস্তিকা, পদ্ম, ঘণ্টাকৃতি, বেলকুঁড়ি প্রভৃতি হিন্দুরীতিও অনুসৃত হত।

স্থাপত্যের উদাহরণ: এই ধরনের স্থাপত্য দেখা যায় দিল্লির কুতুবমিনারের কাছে ‘কুওয়াৎ-উল-ইসলাম‘ মসজিদ ও আজমিরের ‘আড়াই-দিন-কা-ঝোঁপরা’ প্রাসাদে। প্রথমটি ছিল একটি জৈন মন্দির ও দ্বিতীয়টি ছিল একটি বৌদ্ধ মঠ। পরবর্তীকালে সেগুলিকেই ভেঙে মসজিদ ও প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়।

স্থাপত্যের নিদর্শন ও বৈশিষ্ট্য: কুতুবমিনার ইলতুৎমিস নির্মাণ করান। মিনারটি উচ্চতায় ছিল ৭১.৪ মিটার। কুতুবমিনারে লাল ও সাদা বেলে পাথর ও মার্বেল ব্যবহার করা হয়েছে। অপরপক্ষে তুঘলক স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য ছিল ঢালু দেওয়াল। ফিরোজ তুঘলক ‘হৌজখাস’ নামে একটি প্রমোদসৌধ তৈরি করান। আলাউদ্দিন খলজি নির্মাণ করান ‘আলাই-দরওয়াজা’। এটি স্থাপত্যশিল্পের একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন।

মিশ্র স্থাপত্য রীতি: প্রাদেশিক স্থাপত্য রীতিতে আঞ্চলিক ঐতিহ্যের প্রভাব সুস্পষ্ট ভাবে পরিলক্ষিত হয়। জৌনপুর, বাংলাদেশ, গুজরাট, মালব ও দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন রাজ্যে এই মিশ্র স্থাপত্যরীতি পরিলক্ষিত করা যায়। তবে জৌনপুরি স্থাপত্য রীতিতে হিন্দু প্রভাব সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে।

বিভিন্ন স্থাপত্য রীতি: জৌনপুরের অনেক মসজিদ হিন্দু মন্দিরকে অনুকরণ করে তৈরি করা হয়েছিল। অটলাদেবী বা অতল মসজিদ জৌনপুরী রীতির পরিচয়বহ। গুজরাতি রীতিতে ভারতীয় প্রভাব অনেক বেশি। গুজরাটের শিল্পীরা কাঠ ও পাথরে খোদাই করে অতি সূক্ষ্ম কারুকার্য সৃষ্টি করতে অত্যন্ত পটু ছিলেন। আমেদাবাদের ‘জাম-ই-মসজিদ, মান্ডুর হিন্দোলা মহল নামে দরবার কক্ষ গুজরাতি শিল্পরীতির প্রকৃষ্ট নিদর্শন।

শিল্পরীতিতে বাংলার প্রভাব: বাংলাদেশের স্থাপত্যে হিন্দু প্রভাব পড়ার ফলে পদ্ম ও অন্যান্য হিন্দু বৈশিষ্ট্য সূচক নকশার ব্যাপক প্রচলন পরিলক্ষিত হয়। পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদ, একলাবি মসজিদ, ছোটো ও বড়ো সোনা মসজিদ, কদমরসুল প্রভৃতি শিল্পরীতিতে বাংলার বিশিষ্ট শিল্পরীতির পরিচয় অনেকটাই পাওয়া যায়। রাজপুতানা অঞ্চলের মেবারে রাণা কুজের নির্মিত ‘বিজয়স্তম্ভ হিন্দুরীতির স্থাপত্য শিল্পের প্রকৃষ্ট নিদর্শন।

* শিল্পচর্চার ব্যাপকতা: মোগল যুগে স্থাপত্য শিল্পের চরম উন্নতি সাধিত হয়। সাম্রাজ্যের সর্বত্র শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকার ফলে মোগল সম্রাটেরা স্থাপত্য শিল্পে আগ্রহী ছিলেন এবং এইসময় শিল্পচর্চা ব্যাপক পরিমাণে প্রসার লাভ করে। আকবরের রাজত্বকালে স্থাপত্যশিয়ে যে পারসিক প্রভাব ছিল, পরবর্তীকালের স্থাপত্যশিল্পে সেই পারসিক রীতি আর ছিল না। এরপর মোগল স্থাপত্য রীতিতে প্রকৃত অর্থেই ভারতীয় স্থাপত্য রীতি প্রতিফলিত হয়। এক গঠনগত সূক্ষ্ম পরিমিতিবোধ, আলংকারিক কারুকার্য ও সর্বোপরি অনুপম সৌন্দর্য ছিল মোগল স্থাপত্যের বিশেষত্ব।

* মোগলযুগের স্থাপত্য কীর্তি: মোগল স্থাপত্যগুলির মধ্যে হুমায়ুনের সমাধি এবং আগ্রা, দিল্লি ও ফতেপুর সিক্রির প্রাসাদ দুর্গ; সিকান্দ্রায় আকবরের সমাধি, গুজরাটের ‘পঞ্চমহল‘, আমেদাবাদের জামা মসজিদ, লালকেল্লার অভ্যন্তরে ‘দেওয়ান-ই-আম‘, ‘দেওয়ান-ই-খাস’ প্রভৃতি ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে স্থাপত্য শিল্প তার পরিপূর্ণ যৌবনের যাবতীয় রূপ-রস-সুধা নিয়ে শাজাহানের রাজত্বকালে উপস্থিত হয়। শাজাহান নির্মিত ময়ূর সিংহাসন সূক্ষ্ম শৈল্পিক কারুকার্যের এক প্রকৃষ্ট নিদর্শন। তবে শাজাহানের স্থাপত্যকীর্তির সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন হল ‘তাজমহল‘।

শিল্প চাতুর্যে তাজমহল: ফাদার মানরিক মন্তব্য করেন তাজমহলের পরিকল্পনাটি করেন এক ভেনিসের স্থপতি। কিন্তু সমকালীন ইউরোপীয় পর্যটকদের বিবরণ অনুযায়ী এই মতের কোনো যথার্থ প্রমাণ পাওয়া যায় নি। তবে শিল্পচাতুর্যে ও সুষমায় তাজমহল বিশ্বের অন্যতম আশ্চর্য হিসাবে পরিগণিত হয়। শাজাহানের পরবর্তী সময় থেকেই মোগল স্থাপত্যের অবনতি পরিলক্ষিত হয়। কেননা ঔরঙ্গ জের সর্বদাই মুখবিগ্রহে ব্যস্ত থাকতেন। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে শিল্পরসিক ছিলেন না। ফলে মোগল যুগের স্থাপত্যশিল্পের চর্চা শাজাহানের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বিলুপ্তির অতলে তলিয়ে যায়।

☆ সুলতানি ও মোগল আমলে সাহিত্যচর্চা

* সংস্কৃত ভাষার চর্চা: সুলতানি শাসনকালে ভারতে ব্যাপক সাহিত্যচর্চা হয়েছিল। এই সময়ে উত্তর ভারতে কাশী, মিথিলা, নবদ্বীপ প্রভৃতি শ্যান সংস্কৃত ভাষা চর্চার কেন্দ্র হিসাবে প্রসিধি লাভ করেছিল। টোল ও চতুষ্পাঠীতে ক্রাফার সংস্কৃত ভাষার সম্যক চর্চা করতেন।

জীমূতবাহন, বাচস্পতি মিশ্র, রঘুনন্দন ভট্টাচার্য, মাধবাচার্য প্রমুখ পণ্ডিতরা ধর্ম ও স্মৃতিশাস্ত্রে রচনা করতেন। মাধবাচার্য দক্ষিণ ভারতের হিন্দুদের জন্য নিয়মাবলি প্রণয়ন করেন।

সংস্কৃত ভাষাচর্চার প্রভাব: বাংলাদেশে সংস্কৃত কাব্য, নাটক ও অলংকার শাস্ত্র রচনারক্ষেত্রে জয়দেব গোস্বামী, রূপ গোস্বামী এবং জীব গোস্বামী তাঁদের অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দেন। মুসলিম শাসকেরা সংস্কৃত ভাষার পঠন-পাঠনে কোনো বাধা সৃষ্টি না করায় নানা স্থানে সংস্কৃত ভাষা চর্চার বিদ্যালয়ও গড়ে ওঠে।

* ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি: সুলতানি যুগে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। সুলতানরা ফারসি ভাষার বিশেষ অনুরাগী ছিলেন ও এই ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতাও করতেন। তার ফলে এই যুগে ফারসি ভাষায় অজস্র সাহিত্য ও ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করা হয়। সিকান্দার লোদি বহু সংস্কৃত গ্রন্থকে ফারসি ভাষায় অনুবাদ করান। কাশ্মীরের সুলতান জয়নাল আবেদিন মহাভারত এবং কলহনের রাজতরঙ্গিনী গ্রখদুটিকে আরবি ও ফারসি ভাষায় অনুবাদ করান।

বিভিন্ন ফারসি গ্রন্থ: আমির খসরু ও হাসান দেহলবি ফারসি সাহিত্যের সেরালেখক ছিলেন। আমির খসরু ‘হিন্দুস্থানের তোতাপাখি’ নামে প্রসিবি লাভ করেন। তিনি ভারতীয় কাব্যের অনুকরণ করে ‘মসনভি’ বা কাব্য রচনা করেন। তাঁর রচিত ঐতিহাসিক গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-‘কিরান-উস-সাদাইন‘, ‘অশিক‘, ‘তুঘলকনামা’ প্রভৃতি। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ‘ফুতুহাৎ-ই-ফিরোজশাহি‘ প্রণয়ন করেন। ফারসি ভাষায় লেখা ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলির মধ্যে প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলি হল-মিনহাজ-উস-সিরাজ-এর লেখা ‘তবাকৎ-ই-ফিরোজশাহি‘ জিয়াউদ্দিন বরনির লেখা ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহি‘, ইসামির লেখা ‘ফুতুহ-উস-সালাতিন‘ এবং সামস-ই- সিরাজের ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহি’ প্রভৃতি।

* উর্দুভাষার প্রচলন: হিন্দু ও মুসলিম জনসাধারণের কথ্য ভাষা হিসাবে উর্দুভাষা প্রচলন হয়। তুর্কি ভাষায় উর্দু কথাটির অর্থ হল ‘শিবির’। শিবিরবাসী মুসলিম সৈন্যরা হিন্দুদের সঙ্গে কথোপকথনের জন্য উর্দু ভাষাটির প্রচলন করে। উর্দু ভাষার শব্দভান্ডার ফারসি ও হিন্দি ভাষার সংযোগে গঠিত হয়েছে। এই নতুন ভাষা বিজয়ী ও বিজিত সম্প্রদায়ের মধ্যে মনের ভাব আদান-প্রদানের পথকে সুপ্রশস্ত করেছিল। কবি আমির খসরু উর্দু ভাষায় কবিতা ও গান রচনা করে একে সাহিত্যোচিত মর্যাদায় ভূষিত করেন।

হিন্দি ভাষায় কাব্য: হিন্দি ভাষাও এই সুলতানি যুগে সমৃদ্ধি লাভ করে। রামানন্দ ও কবিরের রচনায় এবং সুফি সম্ভদের সংগীতে হিন্দি সাহিত্য চরম উৎকর্ষতা লাভ করে। হিন্দি সাহিত্যে চাঁদ বরদাই রচিত ‘পৃথ্বীরাজ রাসো‘, সরশধর রচিত ‘সামির রাসো‘, ‘হামির কাব্য‘ এবং কবির ও রামানন্দের দোঁহা উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। রানি পদ্মিনীর কাহিনিকে মূল উপজীব্য করে মালিক মহম্মদ জয়সি ‘পদুমাবৎ কাব্য’ রচনা করেন।

* তুলসী দাস ও বিদ্যাপতি: এছাড়া তুলসী দাসের ‘রামচরিতমানস’ প্রকাশিত হয়। এই সময়কার মৈথিলি ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি হিসাবে বিদ্যাপতি আত্মরকাশ করেন। তাঁর রচিত একাধিক মাথুর বিষয়ক বৈয়ব পদাবলির পদ আজও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অঙ্গনে বিরাজ করছে। সাধিকা মীরাবাই রাজখানি ভাষায় বহু ভজন গান রচনা করেন। পাঞ্জাবি ও গুরুমুখি ভাষায় গুরু নানকের এবং মারাঠি ভাষায় নামদেবের বহু রচনা ও উপদেশাবলি উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে।

বহু রচনা ও উপসাহিত্যঃ এই যুগেই বাংলা ভাষার উল্লেখযোগ্য সাহিত্য হিসাবে যে বাংলা ভালবাসা করে সেগুলি হল-বাংলার সুলতান বুকন-উদ্দিন বরবক শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় কবি কৃত্তিবাস ‘রামায়ণ’ রচনা করেন। সুলতান জালালউদ্দিন পৃষ্ঠপোষকতা করতেন পন্ডিত বৃহস্পতি মিশ্রের। এছাড়া মালাধর বসু রচনা করেন ‘শ্রীকৃয়বিজয়‘ কাব্য, কবি পরমেশ্বর রচিত মহাভারতের বঙ্গানুবাদ, বিজয়গুপ্ত রচিত ‘মনসামঙ্গল’ এবং বৈয়ব পদাবলির পূর্বরাগ পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি চন্ডীদাস আবির্ভূত হন।

* বাঙালি কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা: বাঙালি কবি বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস, যশোরাজ খান প্রভৃতি বাংলার সুলতান হুসেন শাহের উচ্চ প্রশংসা কীর্তন করেছেন। হুসেন শাহ যশোরাজ খানের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। চট্টগ্রামের শাসক পরাগল ও ছুটি খাঁ-র পৃষ্ঠপোষকতায় যথাক্রমে পরমেশ্বর ও শ্রীকর নন্দী মহাভারতের অংশ বিশেষ অনুদিত করেন।

সমন্বয়ী ধারার সাহিত্য: মোগল যুগের সাহিত্য সৃষ্টিতে সুলতানি আমলের সমন্বয়ী ধারাটি অব্যাহত ছিল। বৈরাম খানের পুত্র আব্দুর রহমান খান ফারসি ও হিন্দিতে পান্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি হিন্দি ভাষাতেও কাব্য রচনা করেছেন। তাঁর রচিত একটি কাব্যে মেবারের রানা প্রতাপসিংহের গুণকীর্তন কীর্তিত হতে দেখা যায়।

* ফারসিতে অনুবাদ: কবি ফৈজি আকবরের সময়ে প্রাচীন ভারতের বেশ কিছু সাহিত্য গ্রখকে ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেন। আকবর ফারসি, সংস্কৃত ও হিন্দি ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। সম্রাট আকবরের উৎসাহে মহাভারত, রামায়ণ, অথর্ববেদ, যোগবাশিষ্ঠ, রাজতরঙ্গিনী, পঞ্চতন্ত্র হরিবশে, লীলাবতী প্রভৃতি সংস্কৃত গ্রন্থ ফারসি ভাষায় অনুবাদ করা হ্যা।

সুফি ও হিন্দুদর্শন: টোডরমল ভাগবতপুরাণের ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেন। দারা শিকোহ-র ‘মজমল বাহারিণ’ নামক গ্রন্থে সুফিবাদ ও হিন্দুধর্মীয় দর্শন বিষয়ের সমূহ তথ্যাবলি আলোচনা করা হয়েছে। হিন্দিকবি সুরদাস আকবরের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। সুফিসস্তগণ হিন্দি ভাষায় যে সমস্ত পদ রচনা করেছিলেন সেগুলি হিন্দি ভাষার অমূল্য সম্পদ হিসাবে পরিগণিত হয়।

☆ সুলতানি ও মোগল আমলে সংগীতচর্চা

হিন্দু ও মুসলিম সাংস্কৃতির ছাপ সংগীতেও পড়েছিল। তুর্কীরা আরবি সংগীতের ঐতিহ্য ভারতে নিয়ে এসেছিল। সেই সঙ্গে তারা নিয়ে আসে কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র, যমন রবার ও সারণী ও সংগীতের নানা ঢং। সুলতানি আমলে হিন্দু ও মুসলিম সংগীত- শিল্পের মধ্যেও সমন্বয় ঘটে।

* সংগীতে আমির খসরুর অবদান: আমির খসরু ছিলেন এক বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ। তিনি সংগীতের কয়েকটি রাগের প্রবর্তন করেন, যেমন-ইমন, সনম ইত্যাদি। অনেকে মনে করেন, আমির খসরু তবলা বাদ্যযন্ত্রের উদ্ভাবক ছিলেন। হিন্দু ও মুসলিম সংগীতকলার সমন্বয় ফিরোজ তুঘলকের আমলেও চলেছিল। তাঁর আমলে ভারতীয় সংগীতগ্রন্থ ‘রাগদর্পণ’ ফার্সিতে অনুবাদ করা হয়।

* সংগীতের পৃষ্ঠপোষকতা: রাজদরবারে ও অভিজাতদের প্রাসাদে নিয়মিত সংগীতের আসর বসত। জৌনপুরের শর্কি সুলতান হুসেন শাহ্ সংগীতের পরম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। গোয়ালিয়র রাজসভায় উচ্চাঙ্গ সংগীতের নিয়মিত চর্চা হত। সেখানকার রাজা মানসিংহ ছিলেন সংগীতজ্ঞ ও সংগীতের পরম পৃষ্ঠপোষক। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ‘মান কৌতূহল‘ নামে একখানি সংগীত গ্রন্থ রচিত হয়। পরবর্তীকালে মোগলরাও সংগীতের এই ঐতিহ্য গ্রহণ করেন। চিনা দো-ভাষী মাহুয়ানের রচনা থেকে জানা যায় যে, এই যুগে বাংলায় এক ধরনের গায়কশ্রেণি দুপুরে মধ্যাহ্ন আহারের সময় অভিজাতদের আবাসে এসে সংগীত পরিবেশন করতেন। তাঁরা ছিলেন পেশাদার।

সংগীতে শিল্পী সমাবেশ: মোগল সম্রাটগণ সংগীতপ্রিয় ছিলেন। তাঁদের আমলথেকেই দরবারি সংগীতের প্রচলন হয়। বাবর স্বয়ং সংগীত রচয়িতা ছিলেন। প্রার্থনাসংগীত ছিল হুমায়নের অতি প্রিয়। সম্রাট আকবরের রাজসভায় তানসেন, বাজবাহাদুর নামক প্রখ্যাত সংগীত শিল্পীদের সমাবেশ ঘটেছিল। আবুল ফজলের লেখা থেকে জানা যায়, আকবরের রাজসভায় নাকি ছত্রিশ জন সংগীতজ্ঞ ছিলেন। বৈজুবাওরা, বাবা রামদাস, সুরদাস ছিলেন সমসাময়িক কালের প্রসিদ্ধ সংগীতশিল্পী। জাহাঙ্গির এবং শাজাহান উভয়েই সংগীতরসিক ছিলেন। সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সময় থেকেই রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ললিতকলার সবকটি শাখার চর্চাই বন্ধ হয়ে যায়।