মুঘল সাম্রাজ্যে মনসবদারি প্রথা

মুঘল সাম্রাজ্যে মনসবদারি প্রথা (Mughal Samrajye Manasabadari Pratha): Mansabdari practice in the Mughal Empire

* মনসব কথার অর্থ: ‘মনসব’ কথাটির অর্থ সরকারি পদ বা সরকারের দেওয়া পদমর্যাদা,। সম্রাট নিজে মনসবদারদের বাছাই করতেন। মনসবদারদের পদ বংশানুক্রমিক ছিল না। সম্রাট ইচ্ছানুযায়ী যে-কোনো মনসবদারকে উচ্চপদে তুলতে বা নীচে নামিয়ে দিতে পারতেন।

* আধুনিক যুগের অর্থে : মনসবদারিকে আধুনিক যুগের ‘Imperial Service or Civil Service’ বলা যায়। স্যার যদুনাথ সরকারের কথায়, সৈন্য, অভিজাত ও বেসামরিক প্রশাসন-এই তিন নিয়ে গড়ে তোলা হয় মনসবদারি প্রথা।

*• মনসবদারি প্রথার প্রচলন: মোগল সম্রাট আকবর ১৫৭৩-৭৪-এ সম্ভবতমনসবদারি প্রথা চালু করেন। এর আগে তাঁর সাম্রাজ্যে জায়গিরদারি প্রথা চালু ছিল। এই প্রথায় কর্মচারীদের নগদে বেতন দেবার বদলে কিছু পরিমাণ জমি জায়গির দেওয়া হত। তার আয় থেকে জায়গিরদার নিজের এবং তার অধীন সৈন্য ও কর্মচারীদের ভরণ- পোষণের ব্যয় নির্বাহ করত এবং সম্রাটের প্রয়োজন অনুযায়ী তাঁকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করত।

* প্রথার উদ্দেশ্য: জায়গিরদারগণ প্রায়ই নির্দিষ্টসংখ্যক সৈন্য রাখত না এবং ধীরে ধীরে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি অর্জন করে দুর্বিনীত ও বিদ্রোহোম্মুখ হয়ে উঠেছিল। জায়গিরদারি প্রথার এইসব ত্রুটিবিচ্যুতি দূর করার জন্য এবং সম্রাটের ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল একটি সুদক্ষ, সামরিক ও বেসামরিক- উভয় কাজেরই উপযুক্ত আমলাশ্রেণি গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে মনসবদারি প্রথার প্রবর্তন হয়।

* মৌলিকতা: মধ্য এশিয়ায় তুর্কি-আফগান যুগে ও খলজি শাসনকালে এবং শেরশাহের রাজত্বকালে যেভাবে সামরিক বাহিনীর পদস্থ কর্মচারীদের স্তরভেদ করা হত। তা হয়তো আকবরের মনসবদারি প্রথাকে কিছু পরিমাণে প্রভাবিত করেছিল। তবে মনসবদারির মৌলিকত্বও যথেষ্ট ছিল।

* মনসবদারদের ক্ষমতা: মনসবদারের মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি সরকার বাজেয়াপ্তকরে নিত। ফলে মনসবদারগণ শক্তিশালী হতে পারত না। কেউ কেউ অবশ্য বলেন,কোনো মনসবদার জীবদ্দশায় সরকারের কাছ থেকে যে ঋণ নিয়েছিল সরকার তার মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ১৯৭সম্পত্তি থেকে সেই পরিমাণ অর্থ আদায় করে নিয়ে বাকি সম্পত্তি তার উত্তরাধিকারীকে ফিরিয়ে দিত।

মনসবদারদের কাজ: মনসবদারকে সম্রাটের ইচ্ছানুযায়ী সামরিক ও বেসামরিককাজ বা যে-কোনো একটি কাজ করতে হত। সাধারণত মনসবদারগণ নির্দিষ্ট বেতন বা জায়গিরের বদলে নির্দিষ্ট সংখ্যক সৈন্য রাখতে বাধ্য ছিল আকবর মনসবদারদের নগদে বেতন দেওয়াই বেশি পছন্দ করতেন।

মনসবদারদের স্তর: মনসবদারদের ৩৩ টি স্তর ছিল। দশজন সৈন্যের অধিনায়কথেকে ১২ হাজার সৈন্যের অধিনায়কও ছিল। সাধারণত রাজপুত্রগণ ৭ হাজারি থেকে ১২ হাজারি মনসবদার হতেন। সম্রাটের অতি প্রিয়পাত্র কোনো কর্মচারী কখনো-কখনো ৭ হাজারি মনসবদারও হতেন বলে জানা গেছে। সে সব মনসবদারের অধীনে ২০০ বা তার বেশি সৈন্য থাকত, তাদের বলা হত আমির।

দুর্নীতি: মনসবদারি প্রথায় শীঘ্রই নানা দুর্নীতি দেখা দেয়। কম সংখ্যক মনসবদারই নির্দিষ্ট সংখ্যক সৈন্য রাখত। আকবর দুর্নীতি রোখার জন্য সৈন্যদের ঘোড়াগুলি দেগে দেবার এবং সৈন্যদের চেহারার বিবরণ’ লিখে রাখার ব্যবথা করেন। আকবর শত চেষ্টা করেও মনসবদারি প্রথাকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পারেননি। পরবর্তীকালে দুর্নীতি বাড়তেইথাকে।

মনসবদার প্রথার ত্রুটি: বিদেশি, তুর্কি, পারসিক, আফগান ইত্যাদি জাতির লোকেরই বেশি মনসব পেত। কিছু ভারতীয় হিন্দু ও মুসলমানও মনসবদার হত। প্রত্যেক মনসবদার নিজ নিজ জাতির লোকদের সৈন্য হিসাবে নিযুক্ত করত বলে মোগল সৈন্যবাহিনীতে ঐক্যভাব গড়ে ওঠেনি। এই সৈন্যেরা তাদের প্রভু মনসবদারেরই অনুগত ছিল। ফলে সম্রাটের ক্ষতি হয়। তিনি মনসবদারদের সৈন্যবাহিনীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তবে নানা জাতির মনসবদারদের মধ্যে ঐক্য না থাকায় তারা সম্রাটের নিয়ন্ত্রণ থাকতে পারত না।

মোগল রাজশক্তির কেন্দ্রীভূত শাসন ও সংহতি

মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর এবং তাঁর পুত্র হুমায়ুন ভারতে বেসরকারি শাসনব্যবস্থা পত্তন করার অবসর পাননি। এটি করেন মহামতি আকবর। তিনি শুধু ভারতের এক বিশাল অংশকে রাজনৈতিক দিক দিয়েই ঐক্যবধ করেননি তাঁর ওই বিশাল সাম্রাজ্যের একটি সুদক্ষ শাসনব্যকথা, একই মুদ্রাব্যকথা এবং একটি রাষ্ট্রভাষাও চালু করেছিলেন। ড. অনিলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, আকবরের আমল থেকে ঔরঙ্গ জেবের রাজত্বকাল পর্যন্ত মোগল সাম্রাজ্যশক্তি মর্যাদা এবং সাংস্কৃতিক প্রাধান্যের একটি উজ্জ্বল প্রতীকরূপে বর্তমান ছিল।

* কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা: মোগল সম্রাটগণ ভারতে যে কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন তা সম্রাটকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হত। আইন, শাসন ও ১৯৮ইতিহাস পরিচয়বিচারবিভাগীয় সমস্ত ক্ষমতার উৎস ছিলেন এবং স্বৈরতন্ত্রে বিশ্বাসী মোগল সম্রাটগণ। বিচার বিভাগী, উলেমা সম্প্রদায়, অভিজাতবর্গ, মন্ত্রী-কারও নিয়ন্ত্রণ সহ্য করতে প্রস্তুত ছিলেন না। তবে তাঁরা কোরানের নির্দেশ অমান্য করে কোনো আইন বা আদেশ জারি করতেন না। কোনো শরিয়তী আইনের ব্যাখ্যা নিয়ে উলেমাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিলে আকবরের ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত বলে সকলকে মেনে নিতে হত। ঔরঙ্গজেব উলেমাদের। কিছুটা প্রশ্রয় দিলেও তাঁর ওপর তাদের কর্তৃত্ব করতে দিতেন না।

* পিতৃতান্ত্রিক আদর্শ: আকবর বিশ্বাস করতেন যে, ‘ঈশ্বরের ছায়া’ রাজার দায়িত্ব অনেক। তাঁর কর্তব্য হল পিতার মতোই প্রজাদের মঙ্গলসাধন করা। অনিলচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় সংগতভাবেই বলেছেন যে, আকবরের ‘দৈবস্বত্ত্ব অধিকারের’ (Divine Right) নীতি এইভাবে পিতৃতান্ত্রিক সরকারের (Paternal Government) ধারণার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। এখানেই মহামতি অশোকের রাজতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে আকবরের আদর্শের সাদৃশ্য। বাস্তববাদী আকবর প্রশাসনিক ব্যাপারে তাঁর কর্মচারীদের সব কাজে হস্তক্ষেপ করতেন না। তবে তিনি তাদের ত্রুটিবিচ্যুতি সংশোধন করে দিতেন।

উদার ও সমদর্শী নীতি: আকবর বুঝতে পেরেছিলেন যে, হিন্দুপ্রধান ভারতবর্ষে মুসলিম সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করতে হলে উদার ও সমদর্শী নীতির অনুসরণ অত্যাবশ্যক। তিনিই সর্বপ্রথম উপলব্ধি করেন যে, হিন্দুদের মোগল সাম্রাজ্যের প্রশাসনের অংশীদার করলে তারা সাম্রাজ্যের রক্ষণেও শ্রীবৃদ্ধি সাধনে তৎপর হবে।

ভারতের জাতীয় সংহতির সূচনা: সম্রাট আকবর জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকলধর্মের প্রজাদের প্রতি সমদর্শী ছিলেন। যোগ্যতা থাকলে হিন্দুরাও সরকারি উচ্চ পদগুলিতে নিযুক্ত হত ও যথাযোগ্য মর্যাদালাভ করত। এর ফলে হিন্দুরা বিশেষ করে রাজপুতগণ তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি সাধনের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে অকাতরে প্রাণ দিত এবং প্রশাসনে দক্ষতা আনার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করত। আকবর হিন্দুদের ওপর চাপানো বৈষম্যমূলক তীর্থকর, জিজিয়া কর প্রভৃতি তুলে দেওয়ায় তারা সম্রাটের একান্ত অনুগত হয়। এইভাবে আকবর ভারতের জাতীয় সংহতির সূচনা করেছিলেন।

* দীন-ই-ইলাহি : জাতীয় সংহতির ভিত্তিকে সুদৃঢ় করার জন্যই তিনি সর্বজনীন সহিহ্বতাভিত্তিক ‘দীন-ই-ইলাহি’ নামে একটি একেশ্বরবাদী ধর্মমত প্রচার করার চেষ্টা করেছিলেন। এর উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তুলে তাদের মধ্যে সম্প্রীতি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। শাজাহান ও ঔরঙ্গজেব ধর্মীয় সহিবুতার নীতির পরিবর্তন ঘটিয়ে জাতীয় সংহতির কাজকে পিছিয়ে দেন এবং সাম্রাজ্যের বিপনডেকে আনেন।

* প্রাদেশিক শাসন: আকবরের প্রশাসনযন্ত্রের প্রধান স্তস্ত ছিল মনসবদারগণ। তারা সম্রাটের ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল ছিল। আকবর তাঁর সাম্রাজ্যকে ১৫ টি সুবা বা প্রদেশে বিভত্ত করেন। কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার আদলেই প্রাদেশিক শাসনব্যকথা গড়ে তোলা হয়। প্রদেশের শাসনকর্তাকে বলা হত সুবাদার। তিনি সামরিক, প্রশাসনিক ও ফৌজদারি বিচারসংক্রান্ত কার্যাদি করতেন। প্রতিটি সুধায় একজন সামরিক, প্রশাসনিক হতেন। তিনি মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ১৯৯ রাজস্ব আদায় ও দেওয়ানি মামলার বিচার করতেন। সুবাদারের কার্যকলাপের ওপর তিনি সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন।

পঞ্চায়েত গ্রাম শাসন: সুবাগুলি সরকারে এবং সরকার পরগনায় এবং পরগনাকতকগুলি গ্রামে বিভক্ত ছিল। সরকার ও পরগনা শাসনের জন্য বিভিন্ন কর্মচারী ছিল। পঞ্চায়েত গ্রাম শাসন করত। সম্রাট সুবাদার ও দেওয়ানকে নিযুক্ত করতেন। সংবাদ- সংগ্রাহক ও গুপ্তচর মারফত তিনি প্রাদেশিক শাসনসংক্রান্ত সংবাদাদি সংগ্রহ করতেন। সুবাদার ও দেওয়ানদেরও প্রায়ই বদলি করা হত। ফলে স্বৈরাচারের আশঙ্কা কম ছিল।

বিচার ও রাজস্ব ব্যবস্থা: সম্রাট স্বয়ং সর্বোচ্চ বিচারক ছিলেন। তাঁর নীচে ছিল প্রধান এবং অন্যান্য কাজি। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজস্ব আদায়ের নানা ব্যবস্থা চালু ছিল। সাধারণত জমি জরিপ করে উৎপন্ন ফসলের এক-তৃতীয়াংশ রাজস্ব হিসাবে আদায় করা হত। কৃষকদের স্বার্থের দিকে তেমন নজর দেওয়া হত না বলে তারা প্রায়ই শোষিত ও অত্যাচারিত হত। মোগল আমলে সম্রাট, জায়গিরদার, ইজারাদার, জমিদার ও রাজস্বসংগ্রহকারী-সকলেই কৃষকদের শোষণ করত। এজন্য নিরুপায় কৃষকগণ প্রায়ই বিদ্রোহ করতে বাধ্য হত।

সৈন্যবাহিনী: মোগল সম্রাটদের সৈন্যবাহিনী গঠিত হত প্রধানত অশ্বারোহী,পদাতিক ও গোলন্দাজদের নিয়ে। এরা সাধারণত মনসবদারদের পরিচালনায় যুদ্ধ করত। নানা জাতির লোকদের নিয়ে এই বাহিনী গড়ে ওঠায় তাদের মধ্যে ঐক্যবোধ জেগে ওঠেনি। বাহিনীতে বহু বেসামরিক লোক ও হাতি-ঘোড়া, বলদ, গাড়ি প্রভৃতি থাকায় তার গতি ও ক্ষিপ্রতা হ্রাস পায়। পরবর্তীকালে এই বাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও উন্নত রণকৌশল থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তার কার্যকারিতা কমে যায়। মনসবদারদের দুর্নীতিও (নির্দিষ্ট সংখ্যক সৈন্য ও বাহন না রাখা) মোগল সৈন্যবাহিনীকে দুর্বল করে ফেলেছিল। মোগল সম্রাটদের উল্লেখযোগ্য নৌবহর ছিল না। সর্বোচ্চ সেনাপতি ছিলেন স্বয়ং সম্রাট।