মোগল সাম্রাজ্যের প্রসার (আকবর থেকে ঔরঙ্গজেব পর্যন্ত)

মোগল সাম্রাজ্যের প্রসার (আকবর থেকে ঔরঙ্গজেব পর্যন্ত) [Mogal Samrajyer Prasar (Akabar theke Auraṅgajeb paryanta)] Expansion of the Mughal Empire (from Akbar to Aurangzeb)

মোগল সাম্রাজ্যের প্রসার (আকবর থেকে ঔরঙ্গজেব পর্যন্ত)

■ সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিঃ):

হুমায়ুনের মৃত্যুর পর মাত্র তের বছর বয়সে আকবর বৈরাম খাঁর অভিভাবকত্বে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। হুমায়ুন আফগানদের পরাজিত করলেও আফগান শন্তি তখনও বিনষ্ট হয়নি।

পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ: শেরশাহের উত্তরাধিকারী আদিল শাহের প্রধানমন্ত্রী ও সুযোগ্য হিন্দু সেনাপতি হিমু দিল্লি ও আগ্রা অধিকার করেন।

এই সংবাদ পেয়ে আকবরের অভিভাবক, হুমায়ুনের বিশ্বস্ত সেনাপতি বৈরাম খাঁ দিল্লির দিকে এগিয়ে গিয়ে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে হিমুকে পরাজিত ও নিহত করে আকবরের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করেন।

দিল্লি ও আগ্রা আবার আকবরের অধীনস্থ হয়। এর ফলে আফগান শক্তির ভারতে ক্ষমতা দখলের শেষ আশাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এই যুদ্ধের বছর দুয়েকের মধ্যেই আফগানদের সঙ্গে মোগলদের বিরোধিতার পরিসমাপ্তি ঘটে।

মোগল সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা: পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের পর থেকে ভারতে মোগল সাম্রাজ্য বিস্তার করার পথ সুপ্রশস্ত হয়। আকবরই হলেন মোগল সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা।

আকবর (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন ঘোরতর সাম্রাজ্যবাদী সম্রাট। তিনি সর্বদা চাইতেন সমগ্র ভারতে তাঁর একাধিপত্য স্থাপন করতে। তাই নিজের আধিপত্য বিস্তারের জন্য তিনি বহু যুদ্ধে লিপ্ত হন।

তিনি গোয়ালিয়র ও জৌনপুর নিজের অধিকারে আনেন। ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দে বৈরাম খাঁ পদচ্যুত হন আকবরের দ্বারা।

রাজ্যবিস্তার: বীরত্বের জন্য প্রসিং রাজপুত রাজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অযথা লোক ও অর্থবল নষ্ট করতে অনিচ্ছুক আকবর অন্য নীতি আশ্রয় করেন।

তিনি রাজপুতদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে তাঁদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন। অম্বরের রাজা বিহারী মল্ল আকবরের অধীনতা স্বেচ্ছায় স্বীকার করে নেন এবং নিজের কন্যা মানবাই- এর সঙ্গে আকবরের বিবাহকার্য সম্পন্ন করেন। আকবর বিহারীমল্লের পুত্র ভগবান দাস এবং পৌত্র মানসিংহকে উচ্চ মনসবদার হিসাবে রাজসভায় নিযুক্ত করেন।

রাজপুত নীতি: মধ্যভারতের গন্ডোয়ানা রাজ্যের রানি দুর্গাবতীকে পরাজিত করেন আকবরের সেনাপতি আসফ খাঁ। অবশ্য রাজপুত মৈত্রী মোগল সাম্রাজ্যের পক্ষে প্রয়োজনীয় বলে মনে করে আকবর রাজপুতদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে আবন্ধ হন।

বিকানীরের রাজাও স্বেচ্ছায় আকবরের সঙ্গে আপন কন্যার বিবাহ দেন। আকবর তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নেওয়া রাজপুত রাজাদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ও নানা উচ্চপদ এবং সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার অধিকার প্রদান করেন।

রাজপুত নেতাদের বশ্যতা স্বীকার: আকবরের উদারনীতি প্রত্যক্ষ করে ক্রমে রণথম্ভোর, কালঞ্জর, জয়সলমীর, মারবাড়, বুন্দি প্রভৃতি রাজ্যের রাজপুত রাজারা আকবরের অধীনতা মেনে নেন সানন্দে। জয়পুররাজ বিহারীমলের পুত্র মানসিংহ-মোগলের সেনাপতি হয়ে মোগলের আধিপত্য প্রসারিত করেন।

শেষ পর্যন্ত শুধুমাত্র মেবারের রাণা উদয়সিংহ আকবরের বশ্যতা মেনে নিতে অসম্মতি প্রকাশ করেন। এই ঘটনায় ক্রুদ্ধ আকবর মেবারের রাজধানী চিতোর অবরোধ করলে চারমাস পরে উদয়সিংহ চিতোর ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় দখল করে নেন।

হলদিঘাটের যুদ্ধ: অত্যন্ত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে প্রায় সহায় সম্বলহীন অবস্থায় উদয়সিংহের পুত্র রাণা প্রতাপসিংহ দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে আকবরের সঙ্গে অসম সংগ্রামে লিপ্ত থাকেন। প্রতাপসিংহ হলদিঘাটের যুদ্ধে (১৫৭৬ খ্রি.) আকবরের কাছে শোচনীয়ভাবে হার স্বীকার করেন। শেষ জীবনে প্রতাপসিংহ চিতোর ছাড়া মেবারের বেশ কয়েকটি। দুর্গ পুনরায় দখল করে নেন।

দাক্ষিণাত্য জয়ে অগ্রসর: আকবর ১৫৭২-এ গুজরাট এবং ১৫৭৩-এ সুরাট জয় করেন। এগুলি দখল করার ফলে ভারতের পশ্চিম উপকূলের সমৃদ্ধ বন্দরগুলি তাঁর অধিকারে আসে। গুজরাট তাঁর দখলে আসায় সম্রাটের দাক্ষিণাত্যে যাবার পথ উন্মুক্ত হয়। আকবর বাংলা ও বিহারের আফগান শাসক দাউদ খাঁর বিদ্রোহ দমন করেন।

দাক্ষিণাত্য জয়: আকবর দাক্ষিণাত্যের খান্দেশ, বিজাপুর, গোলকুন্ডাও আহম্মদনগরে দূত পাঠিয়ে ওই সকল রাজ্যের সুলতানদের বশ্যতা দাবি করেন। একমাত্র খান্দেশ তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে। আহম্মদনগরের প্রয়াত সুলতানের কন্যা চাঁদবিবি মোগলদের আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা চালান। শেষ পর্যন্ত তিনি ১৫৯৬-এ মোগলদের বেরার প্রদেশটি ছেড়ে দিয়ে তাদের সঙ্গে সন্ধি করেন। এতে অসন্তুষ্ট হয়ে আহম্মদনগরের কিছু অভিজাত চাঁদবিবিকে সরিয়ে দিয়ে বেরার পুনর্দখল করার চেষ্টা করে। এদিকে খান্দেশও স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

আহম্মদনগর দখল: মোগল সৈন্যবাহিনী ১৬০০-খ্রিস্টাব্দে আহম্মদনগর দখলকরে নেয়। ১৬০১-০৪ খ্রিস্টাব্দ আকবর নসীরগড়ের দুর্ভেদ্য দুর্গটি সহ খান্দেশও দখল করেন। বিজাপুর ও গোলকুন্ডার সুলতানদ্বয় তাঁর আধিপত্য স্বীকার করে নিলে তিনি হৃষ্টচিত্তে উত্তর ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন।

বাংলায় আধিপত্য স্থাপন: বাংলায় সুলতান দায়ুদ খাঁকে পরাজিত করে আকবরবাংলাদেশ অধিকার করেন। কিন্তু সমগ্র বাংলায় আধিপত্য স্থাপন করতে তাঁর আরো কিছুদিন সময় লেগেছিল। এক্ষেত্রে তাঁর প্রধান অন্তরায় ছিলেন বার ভূঁইয়া নামে খ্যাত বাংলার সামন্ত নৃপতিগণ।

এঁদের মধ্যে কয়েকজন যেমন বিক্রমপুরের চাঁদ রায় ও কেদার রায়, খিজিরপুরের ঈশা খাঁ, বাকলার কন্দর্পনারায়ণ, যশোহরের প্রতাপাদিত্য মোগলবাহিনীর বিরুদ্ধে শস্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। এঁদের মধ্যে রাজা প্রতাপাদিত্যের শৌর্য ও আত্মত্যাগ ইতিহাসে তুলনাহীন।

বাংলা অধিকার: শেষপর্যন্ত টোডরমল এবং মানসিংহের চেষ্টায় সমগ্র বাংলাদেশমোগল অধিকারে আসে। বীর প্রতাপাদিত্য পিঞ্জরাবিধ হন। সেই অবস্থায় দিল্লির পথে তাঁর মৃত্যু হয়। পরাজিত হলেও বাংলার ভূঁইয়াদের বিশেষত প্রতাপাদিত্যের স্বাধীনতা স্পৃহা, দুর্জয় সাহস এবং অদম্য মনোবল পরবর্তীকালে বাঙালির নবজাগ্রত দেশপ্রেমকে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

সাম্রাজ্যের সীমা: উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে আহম্মদনগর ও বেরার এবং পূর্বে বঙ্গদেশ ও ওড়িশা থেকে সৌরাষ্ট্র এবং উত্তর-পশ্চিমে কাবুল ও কান্দাহার পর্যন্ত আকবরেরসাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়।

* সাম্রাজ্যবাদ নীতি: আকবর প্রথম দিকে নগ্ন সাম্রাজ্যবাদেই বিশ্বাসী ছিলেন। ছলে-বলে কৌশলে রাজ্যবিস্তার করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। পরবর্তীকালে তাঁর সভাসদ ও বন্ধু আবুল ফজল প্রচার করেন যে, অত্যাচারী শাসকদের কবল থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যসমূহের প্রজাদের রক্ষার জন্যই আকবর ওইগুলি দখল করে নিজের উদার আলোকপ্রাপ্ত শাসনব্যবস্থার আওতায় এনেছিলেন।

■ আকবরের শাসনব্যবস্থা:

কেবলমাত্র সমরকুশলী যোধা হিসাবে নয় সুশাসক হিসাবেও আকবর ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর শাসন ব্যবস্থার মূলনীতি ও আদর্শ ছিল প্রজাদের সর্বাধিক কল্যাণ সাধন।

* কেন্দ্রীয় শাসন: কেন্দ্রীয় শাসনে সম্রাট সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তাঁকে সাহায্য করার জন্য কয়েকজন মন্ত্রী ছিলেন যথা-ভকিল বা প্রধানমন্ত্রী, দেওয়ান, মীরবক্সি (সমর), কাজি উল্ কাজাত (প্রধান বিচারক) এছাড়া আরও বিভিন্ন স্তরের কর্মচারী নিযুক্ত ছিলেন।

* প্রাদেশিক শাসন: শাসনকার্যের সুবিধার জন্য সাম্রাজ্যকে ১৫টি সুবায় বিভত্ত করেছিলেন। প্রত্যেক সুবায় একজন করে সুবাদার, দেওয়ান, বক্সী, সদর, কাজি ও ওয়াকিয়ানভিস নিযুক্ত হত।

স্থানীয় শাসন: প্রত্যেক সুবা কয়েকটি ‘সরকারে’ এবং প্রত্যেকটি সরকার কয়েকটি ‘পরগনায়’ বিভক্ত ছিল। পরগনাগুলি আবার কয়েকটি ‘গ্রামে’ বিভক্ত ছিল। পরগনার উল্লেকযোগ্য কর্মচারী ছিলেন ‘ফৌজদার’, আমলগুজার (রাজস্ব ও হিসাব), কাছি, কোতোয়াল প্রভৃতি।

বিচারব্যকথা: সাম্রাজ্যের সর্বপ্রধান বিচারপতি ছিলেন সম্রাট স্বয়ং। এ ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করতেন কাজি-উল-কাজৎ, সদর-উস-সুদুর নামক কর্মচারীরা। গ্রামে বিচার কার্যের ভার ছিল পঞ্চায়েতের ওপর। হিন্দু ও মুসলিম আইন মেনে বিচারকার্য পরিচালিত। হত। একমাত্র সম্রাটই মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিতে পারতেন।

মনসবদারি প্রথা: আকবরের শাসন ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল মনসবদারি। প্রথার প্রচলন, সামরিক ও বেসামরিক শাসন ব্যকথার মূল ভিত্তি ছিল এই মনসবদারি। প্রথা। ‘মনসব’ কথাটির অর্থ পদমর্যাদা। এই মর্যাদা অনুসারে সাম্রাজ্যের পদস্থ কর্মচারীরা। বেসামরিক দায়িত্ব পালনে বাধ্য ছিলেন। আর যারা এই মর্যাদার অধিকারী তাঁদের মনসবদার বলা হত।

মনসবদারদের পদমর্যাদা: প্রত্যেক মনসবদারকে নির্দিষ্ট পরিমাণ সেনা ও ঘোড়া রাখতে হত এবং পদমর্যাদা অনুসারে বেতন স্থির হত। পদমর্যাদার ৩৫টি ক্রম অনুসারে মনসবদাররা ১০ থেকে ১০,০০০ পর্যন্ত যে কোনো পরিমাণের মনসবদার হতে পারতেন।

তবে রাজপরিবারে সদস্যরাই দশহাজারী মনসবদারি পেতেন। এই মনসবদাররা যুদ্ধের সময় সম্রাটকে সৈন্য পাঠাতে বাধ্য ছিলেন। এই প্রথা বংশানুক্রমিক ছিল না। পদোন্নতি বা বরখাস্ত সবকিছুই সম্রাটের ইচ্ছাধীন।

জায়গিরদারী প্রথা: অনেক সময় মনসবদারদের নগদ অর্থে বেতন দানের পরিবর্তে জায়গির পেতেন। এই নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি বা জায়গিরের আয় দ্বারা তারা ব্যয় নির্বাহ করতেন। এই ধরনের মনসবদারদের জায়গিরদার বলা হত। আকবর অবশ্য জায়গির প্রথা পছন্দ করতেন না।

■ আকবরের রাজস্বব্যবস্থা:

আকবর রাজস্ব বিভাগেরও অনেক সংস্কার সাধন করেন। এই কাজে তাঁর প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন রাজা টোডরমল। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজস্ব সংস্কারের এক ব্যাপক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন।

কৃষিজমি জরিপের ব্যবস্থাঃ শেরশাহের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে তিনি সমস্ত কৃষিজমি জরিপের ব্যবস্থা করেন। কৃষিযোগ্য জমির উর্বরতা অনুযায়ী জমিকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয় যথা (১) পোলজ (সব সময় আবাদযোগ্য জমি); (২) পরোটি (যে জমি বছরের কিছু সময় অনাবাদী থাকত); (৩) ‘চাচর’ (যে জমি তিন-চার বছর অনাবাদী ফেলে রাখা হত এবং বানজর (যে জমি দীর্ঘকাল পতিত থাকত)।

জমির শ্রেণি বিভাগ: জমির শ্রেণি বিভাগ অনুযায়ী খাজনার হারও নির্দিষ্ট হত। আগের দশ বছরের কৃষির গড় উৎপাদন ও মূল্যের ভিত্তিতে খাজনার হার নির্দিষ্ট হত। উৎপন্ন শস্যের এক তৃতীয়াংশ রাজকররূপে নেওয়া হত।

দহশালা বন্দোবস্ত: প্রজাদের নগদ টাকা অথবা শস্যে রাজকর দিতে হত। এ বিষয়ে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা১৮৩আকবর শেরশাহ অনুসৃত রাজস্বনীতির বেশ কিছু উৎকর্ষ সাধন করে মৌলিক চিন্তার পরিচয় দেন। তাঁর নব প্রবর্তিত রাজস্ব নীতিকে দহশালা বন্দোবস্ত বলা হত।

* মুদ্রানীতি: আকবর কেন্দ্রীয় টাকশালের সংস্কার সাধন করে রৌপ্যমুদ্রার সঙ্গে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেন। ঐতিহাসিক স্মিথ আকবরের এই মুদ্রানীতির প্রশংসা করেছেন। আকবরের রাজস্বনীতির ভালোমন্দ উভয়দিকই ছিল। খাজনার হার নির্দিষ্ট হওয়ায় খাজনা আদায়ে জোরজুলুম ছিল না। এছাড়া সম্রাট বীজ, সার, কৃষিঋণ ও কৃষি সরঞ্জাম দিয়ে কৃষকদের সাহায্য করতেন।

* প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে খাজনা মকুব: প্রজারা খরা, বন্য ও দুর্ভিক্ষের কবলে পড়লে সম্রাট খাজনা মকুব করে দিতেন। আকবরের এই জনমুখী রাজস্ব নীতির জন্য ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ একে অধিকতর বাস্তবধর্মী ও সুচিন্তিত বলে অভিহিত দিয়েছেন। তবে রাজস্বের হার অত্যন্ত বেশি ছিল এবং প্রাদেশিক রাজারাও রাজস্ব আদায়ে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। ফলে প্রজাদের মাঝে মাঝেই দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন হতে হত।

আকবরের সামরিক ব্যবস্থা:

সৈন্যবাহিনী সজ্জা: আকবর সামরিক বাহিনীরও বহুবিধ সংস্কার সাধন করেন। তাঁর সেনাবাহিনীতে পদাতিক, অশ্বারোহী ও গোলন্দাজ বাহিনী ছিল। এছাড়া ছিল রণহস্তী ও রণতরী। দশ, কুড়ি, ত্রিশটি হাতি নিয়ে এক একটি রণহস্তী বাহিনী ছিল। সম্রাট ছিলেন সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। তাঁর অধীনে অন্যান্য সামরিক পদমর্যাদার কর্মচারীবৃন্দ থাকতেন।

* নৌবহরে ও নৌবাহিনী: বাংলার দক্ষিণ-পূর্বে সমুদ্রোপকূলে ফিরিঙ্গি ও মগ জলদস্যু এবং পশ্চিম উপকূলে পোর্তুগিজ জলদস্যুদের আক্রমণ নিবারণের জন্য মোগল সম্রাটগণের মধ্যে আকবরই সর্বপ্রথম এক শক্তিশালী নৌবহর ও নৌবাহিনী গড়ে তোলেন। নৌবিভাগকে ‘নওয়ারা’ এবং নৌবাহিনীর অধিনায়কদের ‘মীর বহর’ বলা হত। ঢাকা, এলাহাবাদ ও লাহোর ছিল সম্রাটের রণতরী নির্মাণের কেন্দ্র।

আকবরের ধর্মনীতি:

* ধর্মসভা: আকবর নিরক্ষর ছিলেন; কিন্তু বিভিন্ন ধর্মমত ও তত্ত্ব সম্বন্ধে তার ছিল্ প্রবল অনুসন্ধিৎসা। তাই তিনি ফতেপুর সিক্রীতে ‘ইবাদৎখানা’ নামে এক ধর্মসভাগৃহ নির্মাণ করেছিলেন। এখানে সম্রাট বিভিন্ন ধর্মের জ্ঞানীগুণীদের সঙ্গে বিভিন্ন ধর্ম সম্বন্ধে আলোচনা করতেন।

উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় প্রতিনিধি: সমাগত ধর্মীয় প্রতিনিধিবৃন্দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হিন্দু ধর্মাচার্য পুরুষোত্তম, জৈন ধর্মগুরু বিজয়সেন সুরী ও হরিবিজয় সুরী, জেসুইট ধর্মযাজক ফাদার রিডালফ-একোয়া-ভাইবা, মনসেরেট প্রমুখ মনীষী। এছাড়া সুন্নী মুসলমানরাও আকবরের ধর্মসভায় যোগ দিতেন। অনেকে মনে করেন আকবরের উদার ধর্মীয় নীতি তাঁর রাজপুত মহিষী, সুফী সপ্ত এবং পরম সুহৃদ ফৈজী ও আবুল ফজলের দ্বারা বহুল পরিমাণে প্রভাবিত হয়েছিল।

ধর্মীয় উদারতা: আকবর হিন্দু ও মুসলমান প্রজাদের সমান চক্ষে দেখতেন। তাঁর বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিল। তার সামরিক অসামরিক উভয় ক্ষেত্রে তিনি হিন্দুদের এবং মুসলমানদের সমান অধিকার দিয়ে তাঁদের শ্রবা ও সহযোগিতা লাভ করেছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে হিন্দুদের জিজিয়া কর তুলে দিয়ে তিনি তাঁদের তীর্থযাত্রার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। আকবর হিন্দ সমাজের নিষ্ঠুর সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদ এবং বাল্য বিবাহ প্রথা বন্ধ করতে উদ্যোগী। হয়েছিলেন বলেও শোনা যায়।

ধর্মীয় আলোচনা: ধর্ম সম্বন্ধেও আকবরের কোনো গোঁড়ামি ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন, সকল ধর্মেই সমান সত্য আছে। এজন্য তিনি হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান এবং মুসলমান পণ্ডিতগণের সঙ্গে ধর্মবিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতেন। সকলের কথাই। মনোযোগ দিয়ে শুনতেন।

* দীন-ই-ইলাহি প্রবর্তন: শেষপর্যন্ত তিনি সকল ধর্মের সারমর্ম নিয়ে এক নতুন ধর্মমত প্রচার করেন। তাঁর এই নব প্রবর্তিত ধর্মের নাম হয় দীন-ই-ইলাহি বা দিব্য বিশ্বাস। এই ধর্মমত একান্তরূপেই যুক্তিনির্ভর ছিল। কোনো বিশেষ ধর্মমত এতে প্রাধান্য পায়নি। এই ধর্মের কোনো উপাসনা মন্দিরও ছিল না। ছিল না কোনো পুরোহিত বা মৌলভী।

* ধর্মের মূল কথা: দীন-ই-ইলাহি ধর্মমতের সার কথা হল, সুল-ই-কুল অর্থাৎ সকল ধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আদর্শ। এই ধর্মমতের করণীয় কর্তব্যগুলি হল-নিরামিষ ভোজন, দান-ধর্ম পালন, পরস্পরকে ভালবাসা এবং আল্লাহ্ আকবর সম্বোধনে সম্ভাষণ করা। সম্রাটের জন্য ধন, মান, প্রাণ উৎসর্গ করার শপথও এই ধর্মগ্রহণকারীকে নিতে হত। এছাড়া পরমত সহিষুতাও এই ধর্মমতের আর এক প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।

ধর্মমত গ্রহণ: শোনা যায়, সম্রাটের একান্ত অনুগত বীরবল ও অন্যান্য কয়েকজন অনুগৃহীত ব্যক্তি তাঁর সেই নব প্রবর্তিত ধর্মমত গ্রহণ করেছিলেন। বলাবাহুল্য, আকবর তাঁর এই ধর্মমত গ্রহণে কাউকে বাধ্য করেননি। ফলে তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এই ধর্ম লোপ পায়। তথাপি তিনি যে পরস্পর বিবদমান ধর্মগুলিকে একই সূত্রে গ্রথিত করে সর্বধর্মসমন্বয়ের চেষ্টা করেছিলেন তার জন্য তিনি ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

■ আকবরের রাজসভা:

দরবারে বহুগুণীর সমাদর: বিক্রমাদিত্যের নবরত্ব সভার মতো আকবরের দরবারে বহুগুণী ব্যক্তি আশ্রয় লাভ করেছিলেন। তাঁর সভাসদদের মধ্যে ছিলেন ‘আইন-ই আকবরী’ এবং ‘আকবর নামা’ গ্রন্থের লেখক আবুল ফজল, বিখ্যাত পণ্ডিত ও কবি ফৈজী, রাজস্ব সচিব টোডরমল, সেনাপতি মানসিংহ, সুরসিক ও সুকবি বীরবল এবং তানসেনের ন্যায় সংগীতজ্ঞ।

আকবরের আদেশে অর্থববেদ, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি সংস্কৃত ভাষায় লিখিত গ্রন্থের ফারসি অনুবাদ করা হয়। তাঁর রাজত্বকালে ভন্ড কবি তুলসীদাস হিন্দিতে ‘রামচরিতমানস’ রচনা করেছিলেন। এসবই আকবরের সংস্কৃতি বিষয়ে আগ্রহ ও বুচিজ্ঞানের পরিচায়ক।

বিদ্যোৎসাহিতা: সম্রাট নিজে নিরক্ষর ছিলেন; কিন্তু তাঁর জ্ঞান-স্পৃহা ছিলঅপরিসীম। তাঁর ছিল তীক্ষ্ণ মেধা ও স্মৃতিশক্তি। রাজসভায় পণ্ডিতের মুখে ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয়ের আলোচনা শুনে সে সব বিষয় তিনি স্মরণ রাখতে পারতেন। তাঁর রাজসভা উক্ত সব বিদ্বজ্জনের সমাবেশে সর্বদা পূর্ণ থাকত।

রাজসভায় অভিনব মিলনস্থল: আকবর উপলব্ধি করেছিলেন যে, ভারতবর্ষে স্থায়ী শাসনব্যবস্থা স্থাপনের একমাত্র শর্ত ছিল হিন্দু-মুসলমানের অকপট আনুগত্য লাভ। সেজন্য তিনি জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে তাঁর রাজসভায় ঠাঁই দিয়েছিলেন। ফলে তাঁর রাজসভা হয়ে উঠেছিল বিভিন্ন ধর্ম, মনীষী ও পেশার এক অভিনব মিলনস্থল।

শিল্প ও স্থাপত্যেরও পৃষ্ঠপোষক: আকবর শিল্প ও স্থাপত্যেরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। দিল্লিতে হুমায়নের সমাধি, আগ্রার দুর্গ, ফতেপুর সিক্রীর প্রাসাদ তাঁরই আমলে নির্মিত হয়। এছাড়া তিনি বহু দুর্গ, সরাইখানা, বিদ্যালয় ও প্রমোদ গৃহ নির্মাণ করিয়েছিলেন। মোগল চিত্রাঙ্কন রীতিও আকবরের আনুকূল্যে বিকাশলাভ করে। আকবরের রাজত্বের প্রথম শ্রেণির ১৭ জন শিল্পীর মধ্যে ১৩ জনই হিন্দু ছিলেন। এঁদের মধ্যে বশোবন, কিসকু ও হরিবন্স সমধিক খ্যাতিলাভ করেছিলেন। তাঁর আমলে আঁকা ছবিগুলির মধ্যে ‘নল- দময়ন্তী’, ‘কালীয় দমন’, ‘জাফরনামা’ প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে।

সংগীতপ্রিয়তা: সম্রাট আকবর সংগীতপ্রিয় ছিলেন। তাঁর রাজসভায় হিন্দু, ইরাণী, কাশ্মীরী সংগীতজ্ঞ ছিলেন। মিঞা তানসেন ছিলেন সকলের সেরা। অন্যান্যদের মধ্যে বৈজুবাওরা, বাবা রামদাস এবং সুরদাস খ্যাতিলাভ করেন। আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দুস্থানী সংগীত বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে।

কৃতিত্ব: আকবর ইতিহাসে এক অনন্যসাধারণ কীর্তির অধিকারী। তাঁর রাজকীয় গাম্ভীর্য, ধর্মীয় সহিষুতা, প্রজাকল্যাণের আদর্শ, সমদৃষ্টি, শাসনকার্যে মৌলিক চিন্তাধারা তাঁকে রাজকীয় মহিমায় ভূষিত করেছে।

ভারতবর্ষের অধিকাংশ অঞ্চল নিজের শাসনাধীনে এনে এবং জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল শ্রেণির প্রজার শ্রধা অর্জন করে তিনি এক অননুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। প্রকৃতপক্ষে তিনিই প্রথম ভারতবর্ষে এক ধরনের জাতীয় ঐক্যের সূত্রপাত করেছিলেন।

তিনি নিজে ছিলেন সেই জাতীয় ঐক্যের প্রতীক ও প্রেরণাস্থল। এজন্যই বোধ হয়, পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু আকবরকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক (Father of Indian Nationalism) আখ্যায় ভূষিত করেছেন।

■ জাহাঙ্গির (১৬০৫-১৬২৭ খ্রিঃ):

১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর যুবরাজ সেলিম নুরউদ্দিন মহম্মদ জাহাঙ্গির বাদশাহ গাজী নাম ধারণ করে সিংহাসনে বসেন। জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালের সূচনাতেই তাঁকে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র খসরুর সম্মুখীন হতে হয়।

খসরু বিদ্রোহ: খসরু ছিলেন তাঁর পিতামহ আকবরের প্রিয়পাত্র। তাঁর আশা ছিল, পিতামহ তাঁকেই সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যাবেন। সে আশা পূর্ণ না হওয়ায় খসরু পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। জাহাঙ্গির কঠোর হস্তে খসরুর বিদ্রোহ দমন করেন এবং খসরুকে সাহায্য করার অপরাধে পঞ্চম শিব গুরু অর্জুনকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করেন। এখান থেকেই শিখ-মুঘল সংঘর্ষের সূচনা হয়।

* বাংলার বারভূঁইয়াদের দমন: জাহাঙ্গিরের আমলে বাংলার বারভূঁইয়ারা সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এঁদের মধ্যে বিশেষ ক্ষমতাশালী ছিলেন মুসা খাঁ, খাজা ওসমান বায়াজিন কররানী প্রমুখ জমিদারগণ। এঁরা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে থাকেন। ফলে জাহাঙ্গির ইসলাম খাঁকে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করে পাঠান। ইসলাম খাঁ ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বারভূঁইয়াদের যুদ্ধে পরাস্ত করে মোগল শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন।

* দাক্ষিণাত্যে অভিযান: জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালেও মেবারের বিরুদ্ধে মোগল অভিযান অব্যাহত ছিল। রাণা প্রতাপসিংহের পুত্র রাণা অমরসিংহ পিতার ন্যায় বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম চালাবার পর শেষ পর্যন্ত সম্মানজনক শর্তে মোগলের বশ্যতা স্বীকার করেন। আকবর দাক্ষিণাত্য অভিযান করলেও দাক্ষিণাত্যের সব অংশ জয় করতে পারেননি।

দাক্ষিণাত্যে আহম্মদনগর জয়: জাহাঙ্গির দাক্ষিণাত্য বিজয়ে অগ্রসর হলে আহম্মননগরের মালিক অম্বর নামে এক হাবসী মন্ত্রী তাঁকে বাধা দেন। অতঃপর যুবরাজ খুরম সসৈন্যে আহম্মদনগর আক্রমণ করলে মালিক অম্বর পরাজিত হন। ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে মালিক অম্বরের মৃত্যু হলে মোগলগণ দাক্ষিণাত্যে আধিপত্য বিস্তারে সফল হন।

* কান্দাহার বিদ্রোহ: বাংলাদেশের সামন্ত নরপতিদের বিদ্রোহ দমন করেজাহাঙ্গির ওই অঞ্চলে স্বীয় অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালে কাংড়া দুর্গটি মোগলগণ অধিকার করলেও ১৬২২ খ্রিস্টাব্দে কান্দাহার তাঁদের হস্তচ্যুত হয়। ওই বছর পারস্যের শাহ কান্দাহার আক্রমণ করে মোগলদের বিতাড়িত করেন। জাহাঙ্গির শাহজাহানকে কান্দাহার পুনরুদ্ধার করতে আদেশ দিলে শাহজাহান পিতার আদেশ অমান্য করেন। ফলে আর কান্দাহার পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়নি।

* শাসক হিসাবে জাহাঙ্গিরের দুর্বলতা: জাহাঙ্গির সম্রাট হলেও সাম্রাজ্য শাসনে কার্যত তাঁর পত্নী নূরজাহানের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিলেন। নূরজাহানের পূর্ব নাম ছিল মেহেরুন্নিসা।

তিনি বর্ধমানের জায়গিরদার শের আফগানের পত্নী ছিলেন। জাহাঙ্গিরের বিরুখে বিদ্রোহের অপরাধে শের আফগানের প্রাণদণ্ড হয়। কয়েক পছর পর জাহাঙ্গির শের আফগানের বিধবা পত্নী মেহেরুন্নিসাকে বিয়ে করেন (১৬১১ খ্রিঃ)। বিয়ের পর মেহেরুন্নিসার নাম হয় নূরজাহান বা জগতের আলো।

* নূরজাহানের আধিপত্য: প্রধানা মহিষী পদে অভিষিক্ত হবার পর নূরজাহান শাহজাহানের বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল জাহাঙ্গিরের অন্য পুত্র শাহরিয়রের সঙ্গে নিজ কন্যার বিয়ে দিয়ে তাকেই সিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী রূপে গড়ে তোলা। ফলে শাহজাহান পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন।

সেনাপতি মহাবৎ খাঁ সে বিদ্রোহ দমন করলেও নিজে শেষ পর্যন্ত নূরজাহানের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে শাহজাহানের পক্ষে যোগ দেন। এই গৃহবিবাদের মধ্যেই জাহাঙ্গিরের মৃত্যু হয় (১৬২৭ খ্রিঃ)।

ইউরোপীয় বণিকদের সঙ্গে সম্পর্ক: জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল, ইউরোপের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের সূচনা।

১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়ম হকিন্স ইংল্যান্ডের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধিরূপে ভারতে আসেন এবং জাহাঙ্গিরের কাছে সুরাটে ইংরেজ বাণিজ্য কুঠি নির্মাণের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন।

সে প্রার্থনা নিষ্ফল হয়। কয়েক বছর পর স্যার টমাস রো ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের প্রতিনিধিরূপে ভারতে আসেন। তিনি জাহাঙ্গিরের কাছ থেকে আমেদাবাদ, সুরাট, বোম্বাই ও মাদ্রাজে ইংরেজ বাণিজ্য কুঠি নির্মাণের অনুমতিনূরজাহানআদায় করেন।।

* জাহাঙ্গিরের চরিত্র: জাহাঙ্গিরের চরিত্রে নানা পরস্পরবিরোধী গুণের সমাবেশ ঘটেছিল। একদিকে তিনি ছিলেন দয়ালু, প্রজাবৎসল রাজা, অন্যদিকে, তিনি ছিলেন খামখেয়ালী ও নিষ্ঠুর।

এছাড়া তিনি অহিফেনসেবী, অত্যন্ত মাদকাসক্ত এবং বিলাসী ছিলেন। তাঁর চরিত্রের প্রধান দুর্বলতা ছিল তাঁর আলস্য ভোগবিলাস ও প্রিয়তমা পত্নী নূরজাহানের একান্ত আনুগত্য। তাঁর ভোগবিলাস ও আলস্যের সুযোগ নিয়েই তাঁর পত্নী নূরজাহান সাম্রাজ্যের যাবতীয় ক্ষমতা করায়ত্ত করেছিলেন।

* কৃতিত্ব: জাহাঙ্গির সাহিত্য ও শিল্পের অনুরাগী ছিলেন। চিত্র সমালোচক হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। তাঁর আমলের বিদধ চিত্রশিল্পী ছিলেন ফারুক বেগ ও মহম্মদ মুরাদ। তাঁর আমলে নির্মিত সেকেন্দ্রায় পিতা আকবরের সমাধি মন্দির এবং নূরজাহানের পিতার স্মৃতিসৌধ ইতমাদ-উদ্‌-দৌলার সমাধি জাহাঙ্গিরের স্থাপত্যকীর্তির উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। ফারসি, হিন্দি ও তুর্কি ভাষায় তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ছিল। তুর্কিভাষায় রচিত তাঁর আত্মজীবনী তুজুক-ই-জাহঙ্গিরি তাঁর সাহিত্য প্রতিভার নিদর্শন।

■ শাজাহান (১৬২৭-১৬৫৮ খ্রিঃ):

জাহাঙ্গিরের মৃত্যুর পর ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর তৃতীয় পুত্র খুরম মোগল সম্রাট হন। দাক্ষিণাত্য অভিযানে পুত্রের সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ জাহাঙ্গির তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘শাজাহান’ যার অর্থ ‘পৃথিবীর সম্রাট’। অতঃপর এই উপাধি নিয়ে তিনি দিল্লির সিংহাসনে বসেন।

রাজ্যজয়: রাজত্বের প্রারম্ভেই তিনি তাঁর সম্ভাব্য সকল প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করে সিংহাসন নিষ্কণ্টক করেন। এরপর তিনি আসামের আহমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে কামরূপ জেলার পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত মোগল সাম্রাজ্যের পরিধিকে বিস্তৃত করেন। তিনি কান্দাহার, বল্য ও বদকশানও নিজের অধিকারে আনতে সমর্থ হন। কিন্তু অচিরেই সেগুলি তাঁর হাতছাড়া হয়ে যায়।

* কান্দাহার দখলের চেষ্টা: শাজাহান বারবার চেষ্টা করেও কান্দাহার দখল করতে সমর্থ হননি। অথচ এই অভিযানে রাজকোষের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়েছিল। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি আহম্মদনগর রাজ্যটিকে মোগল্ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। বিজাপুর ও গোলকুন্ডা রাজ্যদুটিও তাঁর অধীনতা মেনে নেয়। শাজাহানের তৃতীয় পুত্র ঔরঙ্গজেব ওই দুটি রাজ্যের কিয়দংশ অধিকারে এনেছিলেন।

সম্রাটের শেষজীবন: শাজাহানের শেষ জীবন অতি দুঃখে অতিবাহিত হয়। তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর চার পুত্র দারা, সুজা, ঔরঙ্গ জেব ও মুরাদ সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। শেষ পর্যন্ত এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ভ্রাতাদের হত্যা এবং বিতাড়িত করে, পিতাকে গৃহবন্দী করে ঔরঙ্গজেব মোগল সিংহাসন অধিকার করেন। আগ্রার দূর্গে আট বছরের বন্দী জীবনে দুঃসহ যন্ত্রণা ও নির্যাতন ভোগ করে ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে শাজাহানের মৃত্যু হয়।

* চরিত্র: শাজাহানের চরিত্রে বিবিধ গুণের সমাবেশ দেখা যায়। তিনি ছিলেন একাধারে অসাধারণ কর্মোদ্যোগী, বিদ্বান, বুদ্ধিমান, স্নেহপ্রবণ; পত্নীগতপ্রাণ, গুণগ্রাহী এবং আড়ম্বরপ্রিয় সম্রাট। ইউরোপীয় পর্যটকগণ তাঁর আড়ম্বরপ্রিয়তা ও জাঁকজমকের বিশেষ প্রশংসা করেছেন।

* সাহিত্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা: শাজাহান ছিলেন সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। তাঁর রাজসভায় বহু জ্ঞানী গুণী, হিন্দু কবি, দার্শনিক, সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিকগণ অলঙ্কৃত করতেন। একই সঙ্গে শাজাহানের পৃষ্ঠপোষকতায় পারসিক, হিন্দি ও সংস্কৃতভাষা, গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতি সব কিছুই উৎকর্ষতা লাভ করে। তাছাড়া এই সময়েই আবির্ভূত হন ‘গঙ্গাধর’ ও ‘গঙ্গালহরী’ কাব্যরচয়িতা জগন্নাথ পণ্ডিত, ‘পাদশাহনামা’ রচয়িতা ঐতিহাসিক আবদুল হামিদ লাহোরী, সংগীতজ্ঞ সুখসেন এবং আরও অনেকে।

শাজাহানের রাজত্বকালের জাঁকজমক:

শাজাহানের রাজত্বকাল জাঁকজমক ও আড়ম্বরের জন্য প্রসিব। বাবরের

মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ১৮৯ রাজত্বকালকে যদি মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাকাল, আকবরের রাজত্বকালকে যদি সাম্রাজ্য বিস্তারের কাল বলা হয়, তবে শাহজাহানের রাজত্বকালকে শাস্তি, সুস্থিতি ও সমৃদ্ধিরকালরূপে বর্ণনা করা যায়।

* শিল্প ও স্থাপত্যের বিকাশ: শিল্পকীর্তির জন্যই মধ্যযুগের ইতিহাসে শাজাহানপ্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। তিনি তাঁর সময়ে যে সমস্ত শিল্পকীর্তিগুলি স্থাপন করেছেন সেগুলি হল-দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস, শিশমহল, লালকেল্লা, মোতিমহল উল্লেখযোগ্য। এছাড়া শাহজাহান প্রায় দু’কোটি টাকা ব্যয়ে ময়ূর সিংহাসন নামে একটি সুরমা সিংহাসন নির্মাণ করেছিলেন, পৃথিবীতে যার তুলনা ছিল না।

শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যের নিদর্শন: শাহজাহানের আমলে নির্মিত স্থাপত্য কীর্তির সবচেয়ে উজ্জ্বল নিদর্শন যমুনার তীরে নির্মিত বিশ্ববিখ্যাত ‘আগ্রার তাজমহল’। প্রিয়তমা পত্নী মমতাজ মহলের স্মৃতিকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য এই অনুপম মার্বেল পাথরের শ্বেতসৌধটি নির্মাণ করান। এটি পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের মধ্যে অন্যতম।। তাজমহল নামে মমতাজের এই স্মৃতি মন্দিরটি তৈরি করতে প্রায় ২২ বছর সময় লেগেছিল, খরচ হয়েছিল তিন কোটি টাকা। স্বপতিকার ছিলেন পারস্যের সিরাজ শহরের অধিবাসী ওস্তাদ ঈশা।

অন্যান্য স্থাপত্যকীর্তি: শাজাহানের অন্যান্য স্থাপত্য কীর্তির মধ্যে আছে দিল্লিতে স্বনামে নির্মিত শহর ও রাজপ্রসাদ শাজাহানবাদ এবং লাহোরে নির্মিত জাহাঙ্গিরের স্মৃতিসৌধ। মোগল চিত্রকলার সর্বোত্তম বিকাশ শাজাহানের আমলেই হয়েছিল।

সুবর্ণযুগ আখ্যা: সাম্রাজ্যের বিশালতা, আভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃঙ্খলা, বিত্তবৈভবের প্রাচুর্য এবং অবিস্মরণীয় শিল্পকীর্তি শাজাহানের রাজত্বকালকে গৌরবমণ্ডিত করেছিল। এই কারণে অনেক ঐতিহাসিক তাঁর রাজত্বকালকে মোগল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ আখ্যা দিয়েছেন।

* মোগল সাম্রাজ্যের অবনতির সূচনা: শাহজাহানের রাজত্বকালে আপাত সমৃদ্ধির অন্তরালে ছিল দাক্ষিণাত্য ও গুজরাতের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রাদেশিক শাসকদের ও লোভী জায়গিরদারদের অত্যাচার এবং জনগণের চরম দারিদ্র্য। শুরু হয়েছিল হিন্দু ও শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার। তাই বলা যায় যে এযুগে আপত উৎকর্ষতার পাশেই আবার শুরু হয়েছিল অবনতির সূচনা।

■ ঔরঙ্গজেব (১৬৫৮-১৭০৭ খ্রিঃ):

উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব: শেষ জীবনে সম্রাট শাহজাহান অসুখ হয়ে পড়লে তাঁর চার পুত্রের মধ্যে উত্তরাধিকারের প্রশ্নে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। চার পুত্র হল-দারা, সুজা, ঔরঙ্গজেব এবং মুরাদ। শেষ পর্যন্ত তৃতীয় পুত্র ঔরঙ্গজেব বাকি ভাইদের হত্যা করে ও বৃদ্ধ পিতাকে বন্দি করে সিংহাসনে আরোহণ করেন।

রাজ্যবিস্তার: সিংহাসনে আরোহণ করেই ঔরঙ্গজেব বিদ্রোহী আসামের আহোম ও কোচবিহারের কোচদের বিরুদ্ধে বাংলার শাসনকর্তা মিরজুমলাকে নিয়োগ করেন। তিনি আহোমরাজকে পরাস্ত করে মোগলদের অধীনতা স্বীকারে বাধ্য করেন। তিনি কোচবিহারের রাজাকেও পরাস্ত করেন।

কিন্তু মিরজুমলা বাংলার রাজধানী ঢাকায় ফেরার পথে মৃত্যুবরণ করেন। এর ফলে আহোমরা তাদের হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধার করে। বাংলায় পরবর্তী সুবাদার নিযুক্ত হন শায়েস্তা খাঁ। শায়েস্তা খাঁ পোর্তুগীজ জলদস্যুদের দমন এবং আরাকান রাজার কাছ থেকে চট্টগ্রাম দখল করে মোগল সাম্রাজ্যের সীমা ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেন।

উপজাতি বিদ্রোহ দমন: উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে দুর্ধর্ষ পাঠান এবং আফগান উপজাতিগুলি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে ঔরঙ্গজেব ভেদনীতি ও সামরিক শক্তির সাহায্যে তাঁদের দমন করে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত সুরক্ষিত করেন। ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালেই মোগল সাম্রাজ্যের আয়তন সর্বাধিক বৃদ্ধি পায়।

কিন্তু তাঁর কতকগুলি ভ্রান্ত নীতির ফলে তাঁর রাজত্বকালেই বিশাল মোগল সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তাঁর মধ্যে অন্যতম হল দাক্ষিণাত্য নীতি, রাজপুতনীতি, ধর্মীয় নীতি প্রভৃতি।

■ ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি:

মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব তাঁর রাজত্বের শেষ ২৬ বছর দাক্ষিণাত্যে নানা সমস্যার সমাধানে অতিবাহিত করেন। তাঁর রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার ফলে দাক্ষিণাত্য ক্ষত তাঁর জীবন ও সাম্রাজ্যকে শেষ করে দেয়।• বিজাপুর ও গোলকুন্ডা: দক্ষিণ ভারতের দুটি সিয়াপন্থী সুলতানি রাজ্য বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা শাজাহানের সময়েই ঔরঙ্গজেব অধিকার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শাজাহানের অনিচ্ছায় তা সম্ভব হয়নি।

* মারাঠা দমনে ব্যর্থতা: সিংহাসনে বসেই দক্ষিণ ভারতে মহারাষ্ট্রের উদীয়মান মারাঠা শক্তিকে দমনে ঐইরঙ্গজেব সচেষ্ট হন। শিবাজী মোগলদের উপর ক্রমাগত আক্রমণ চালান। জয়সিংহ ও দিলির খাঁ শিবাজীকে বন্দী করেও ধরে রাখতে পারলেন না। ঔরঙ্গজেব শিবাজীকে রাজা উপাধি দিয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করলেন; তাতেও ব্যর্থ হন।

বিজাপুর ও গোলকুন্ডা অভিযান: ঔরঙ্গজেবের বিদ্রোহী তৃতীয় পুত্র আকবর মারাঠা অধিপতি শত্রুজির সাথে যোগ দিলে তাকে ধরার জন্য সম্রাট স্বয়ং ১৬৮২-তে দাক্ষিণাত্যে আসেন।

শিবাজির পুত্র শত্রুজি আকবরকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। আকবর পারস্যে পলায়ন করেন। ঔরঙ্গজেব প্রথমেই শত্রুজির বিরুদ্ধে অগ্রসর না হয়ে দক্ষিণ ভারতের দুটি শিয়া মুসলিম রাষ্ট্র বিজ্ঞাপুর ও গোলকুন্ডা জয়ে মন দেন। কারণ এই দুটি রাজ্যের দুজন সুলতান মোগলদের বিরুদ্ধে মারাঠাদের সাহায্য করতেন।

* বিজাপুর ও গোলকুন্ডা গ্লাস: বিজাপুর, গোলকুন্ডা ও মারাঠাশক্তি মোগলদের মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা১৯১সাধারণ শত্রু বলে মনে করত। ঔরঙ্গজেব বিজাপুর আক্রমণ করে আদিল শাহকে আত্ম সমর্পণে বাধ্য করেন।

আবদুল্লা পনির বিশ্বাসঘাতকতায় গোলকুন্ডার সুলতান কুতুব শাহ ঔরঙ্গজেবের কাছে ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে পরাস্ত হন। এইভাবে মারাঠাদের যথেষ্ট শক্তিশালী রেখে বিজাপুর ও গোলকুন্ডা রাজ্য দুটি ঔরঙ্গজেব গ্রাস করেন।

দাক্ষিণাত্য নীতির ফলাফল: ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি কোনো স্থায়ী ফল প্রসব করেনি। কোনো কোনো ঐতিহাসিক ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতিকে দাক্ষিণাত্য ক্ষত বলে বর্ণনা করেছেন।

দাক্ষিণাত্য নীতির কুফলগুলি হল: ডঃ স্মিথ ঔরঙ্গজেবের ব্যর্থতাকে লক্ষ করে বলেন, ‘The Deccan was the grave of his reputation as well as his body.”

* প্রথমত, ঔরঙ্গজেব দুটি সিয়া রাজ্য ধ্বংস করে মারাঠাদের নিশ্চিত করে দেন। বিজাপুরী সৈন্যরা মারাঠাদের দলে যোগ দিয়ে মারাঠাদের শক্তি বাড়িয়ে দেয়।

☆দ্বিতীয়ত, দীর্ঘকাল ধরে দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলে রাজকোষ প্রায় শূন্য হয়ে গিয়েছিল এবং সৈন্যবাহিনীর দক্ষতাও বিনষ্ট হয়েছিল, তারা সাহস ও আত্মপ্রত্যয়হারিয়েছিল।

* তৃতীয়ত, ঔরঙ্গজেব শত চেষ্টা করেও মারাঠাদের প্রতিরোধ চূর্ণ করতে পারলেন না ও মারাঠা শক্তিকে খর্ব করতে পারেননি। দীর্ঘকাল (২৬ বৎসর) উত্তর ভারত হতে অনুপস্থিত থাকার ফলে ওই অঞ্চলের শাসনকর্তাগণ স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল, চারদিকেঅশান্তি ও বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল।

* দাক্ষিণাত্য ক্ষত: সুতরাং দেখা যায় যে দাক্ষিণাত্য নীতি কেবল তাঁর ব্যর্থতা নয়, মোগল সাম্রাজ্যের চরম ক্ষতি সাধন করেছিল। মোগল সৈন্যবাহিনীর অপরাজেয়ত্বে লোকের বিশ্বাসে চিড় ধরে এবং মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পথটি প্রশস্ত হয়। যুদ্ধক্লান্ত, হতাশ, বৃদ্ধ সম্রাট ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে প্রয়াত হন। দাক্ষিণাত্যে তাঁর দেহ ও গৌরব একই সঙ্গে সমাধিস্থ হল। স্যার যদুনাথ সরকার সংগতভাবেই বলেছেন যে, ‘দাক্ষিণাত্যেরদুষ্টক্ষত ঔরঙ্গজেবের সর্বনাশ করেছিল।

শিবাজীর নেতৃত্বে স্বাধীন মারাঠা রাজ্য প্রতিষ্ঠা:

* শিবাজীর জন্ম ও বাল্যজীবন: ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দে শিবনের গিরি দুর্গে শিবাজীর জন্ম হয়। শিবাজীর পিতা শাহজী বিজাপুরের সুলতানের অধীনে জায়গিরদার হিসাবে কর্ণটিকে থাকতেন। তাই শিবাজীর মাতা জিজাবাঈ এবং শিবাজী দাদাজী কোন্ডদেবের তত্ত্বাবধানে পুনায় বাস করতেন। দাদাজী কোন্ডদেব শিবাজীকে অশ্বারোহণ ও অস্ত্রচালনা শিক্ষা দেন। শিবাজী বাল্যকালে মাওয়ালী সম্প্রদায়ের লোকদের নিয়ে এক সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন।

রাজ্য দখল: শিবাজী তাঁর মাওয়ালী সৈন্যদের সাহায্যে কয়েকটি ছোটো খাটো গিরি দুর্গ অধিকার করেন। এগুলোকে কেন্দ্র করে শিবাজী একটি ক্ষুদ্র স্বাধীন মারাঠা রাজ্য গড়ে তোলেন। ক্রমে তিনি কোঙ্কন প্রদেশ ও জীগলি রাজ্য দখল করেন।

* বিজাপুরের সাথে সংঘর্ষ: শিবাজী একে একে পানহালা, জিপ্তি, ভেলোর প্রভৃতি স্থান দখল করলে বিজাপুরের সুলতান শিবাজীকে দমন করার জন্য আফজল খাঁকে পাঠালেন। শিবাজীর হাতে আফজল খাঁর পরাজয় ও মৃত্যু ঘটলে সুলতান বাহিনী পরাজিত হয়।

মোগল-আরাঠা সংঘর্ষ: আফজল খাঁর মৃত্যুর পর শিবাজী দাক্ষিণাত্যে মোগল অধিকৃত অঞ্চলগুলি লুটপাট করতে থাকলে ঔরঙ্গজেব প্রথমে শায়েস্তা খাঁকে প্রেরণ করেন। শায়েস্তা খাঁ শিবাজীর হাতে পরাজিত হয়ে দাক্ষিণাত্য ত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরে শাহজাদা মুয়াজ্জমও অকৃতকার্য হন। শিবাজী সুরাট বন্দর লুণ্ঠন করেন।

পুরন্দরের সন্ধি: অতঃপর মোগল সম্রাট রাজপুতরাজ জয়সিংহকে শিবাজীর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। শিবাজী পুরন্দরের সন্ধি করতে বাধ্য হন। সন্ধির শর্তানুযায়ী শিবাজী ২৩টি দূর্গ ও বেশ কিছু অঞ্চল ছেড়ে দেন এবং বার্ষিক কর দিতে রাজী হন।

আগ্রা গমন ও পলায়ন: সেনাপতি জয়সিংহের পরামর্শে শিবাজী আগ্রায় গেলে ঔরঙ্গজেব তাঁকে আগ্রা দুর্গে বন্দি করে রাখেন। শিবাজী কৌশলে পলায়ন করে দেশে ফিরে আসেন।

শিবাজীর রাজ্যাভিষেক: দেশে ফিরে শিবাজী ক্রমাগত মোগল রাজ্য আক্রমণ করে ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন। ঔরঙ্গজেব শিবাজীকে ‘রাজা’ উপাধি দান ও বেরারের জায়গির প্রদান করে শান্ত করতে চাইলেন। ১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে শিবাজী রায়গড়ে মহাসমারোহে ‘ছত্রপতি’ উপাধি ধারণ করে রাজপদে অভিষিক্ত হন।

রাজ্যসীমা: শিবাজীর রাজ্য উত্তরে সুরাটের নিকটবর্তী ধরমপুর থেকে দক্ষিণে কানাড়া জেলা, পূর্বে বাগনালা থেকে পশ্চিমে আরব সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

* মৃত্যু: ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে শিবাজীর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগেই তিনি একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং মারাঠা জাতি উত্থানের পথ প্রশস্ত করে যান।

■ ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতি:

ঔরঙ্গজেবের ধর্মাখ নীতির আর এক বিষময় পরিণাম হল রাজপুতগণের বিরোধিতা। আকবরের আমলে যে রাজপুতগণ মোগল সাম্রাজ্যের স্তস্তস্বরূপ ছিলেন, ঔরঙ্গজেবের আমলে সেই রাজপুতগণ তাঁরই বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন।

মাড়বার অধিকার: মাড়বারের রাজা যশোবন্ত সিংহকে ঔরঙ্গজেব উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন। ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে যশোবন্ত সিংহের মৃত্যু হলে ঔরঙ্গজেব মাড়বার অধিকার করেন। অতঃপর যশোবন্ত সিংহের মৃত্যু হলে ঔরঙ্গজেব মাড়বার অধিকার করেন।

মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা মোগল ও রাঠোর বিরোধ: অতঃপর যশোবস্তের বিধবা স্ত্রী ও শিশুপুত্র অজিতসিংহকেদিল্লির মোগল দরবারে এনে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করলে রাঠোরগণ দুর্গাদাসের নেতৃত্বেমোগলদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেন। ঔরঙ্গজেব যুবরাজ আকবরকে রাঠোরদের বিরুদ্ধেপ্রেরণ করেন।

কিন্তু আকবর রাঠোরদের বিরুদ্ধে সাফল্যলাভে ব্যর্থ হলে ঔরঙ্গজেব তাঁকেসেই দায়িত্ব থেকে অপসারিত করেন। এতে আকবর অপমানিত হয়ে রাঠোরের পক্ষেযোগদান করায় ঔরঙ্গজেবের বিপদ আরও বৃদ্ধি পায়।

মোগল-রাঠোর সন্ধি: ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেব জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তন করে মেবারের রাণা রাজসিংহকে সেই কর দিতে বাধ্য করেন; ফলে তিনিও রাঠোরের সঙ্গে যোগ দেন। কূটবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে ঔরঙ্গজেব আকবরকে রাজপুতদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করলেও রাজপুতদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে চূড়ান্ত জয়লাভে ব্যর্থ হন। ১৬৬ খ্রিস্টাব্দে রাজসিংহের পুত্র অজিতসিংহ ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে সন্ধি করলেও রাঠোরগ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকেন।

মোগড়া পৌরি মোগল সংঘর্ষের অবসান: শেষপর্যন্ত ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তাঁর প্রথম মাহাদুর শাহ অজিতসিংহকে মারবাড়ের অধিপতি বলে স্বীকার করে দি রাজপুতানায় রাঠোর-মোগল সংঘর্ষের অবসান হয়। বস্তুত রাজপুতদের সঙ্গে দীর্ঘকা সংগ্রামে লিপ্ত থেকে সৈন্যক্ষয় ও অর্থব্যয় ছাড়া ঔরঙ্গজেবের আর কোনো লাভ হয়নি পরন্তু রাজপুতদের নিরবচ্ছিন্ন বিরোধিতা মোগল সাম্রাজ্যের পক্ষে বিশেষ ক্ষতির কার হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

■ ঔরঙ্গজেবের শাসনব্যবস্থা:

ঔরঙ্গাজেব সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছরকাল রাজত্ব করেছিলেন। এর পুরো সময়টাই যুদ্ধবিগ্রহ ও বিদ্রোহ দমনে অতিবাহিত হয়েছিল। ফলে তিনি শাসনকার্যের মনোযোগ দেবার অবকাশ পাননি। তাছাড়া তাঁর চরিত্রের প্রধান ত্রুটি ছিল সন্দেহবাতিকতা। তিনি কাউকেই বিশ্বাস করতেন না; প্রাশিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডারিতে মতো তিনি একাকী শাসন বিভাগের সব কাজ করতে চাইতেন।

সম্রাট সর্বক্ষমতার উৎস: সাম্রাজ্যের সমস্ত ক্ষমতা সম্রাটের কুক্ষিগত ছিল। ফয়ে কোনো কাজই তিনি সাফল্যের সঙ্গে করে উঠতে পারতেন না। পরন্তু পবিত্র কোরানে নির্দেশ অনুসারে তিনি রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কাজক পরিচালনা করতেন বলে সাম্রাজ্যের বৃহত্তর প্রজাবৃন্দের বিরাগভাজন হয়েছিলেন।

* শাসনক্ষমতার বিকলতা: শাসনব্যবস্থায় অত্যন্ত কঠোর নীতি প্রয়োগ করে এব রাজকর্মচারীগণকে কোনোরূপ দায়িত্ব না দিয়ে তিনি তাঁর মন্ত্রী ও কর্মচারীবৃন্দকে নিয়ে কেরানিতে পরিণত করেন। এছাড়া কর্মচারীগণের মধ্যে ভেদনীতি প্রয়োগ করে তিনি তাঁদের মধ্যে অহেতুক সন্দেহ ও পারস্পরিক অবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলেন। এতে সম শাসনযন্ত্রটিই বিকল হয়ে পড়ে।

শাসন কৃতিত্ব: আকবরের মতো ঔরঙ্গজেবও প্রতিটি প্রদেশে একজন শাসনকর্ত একজন দেওয়ান ও অন্যান্য কর্মচারী নিযুক্ত করতেন। তাঁরা নিজ নিজ কাজকর্মের জন একমাত্র সম্রাটের কাছেই দায়ী থাকতেন। কিন্তু এসব সত্ত্বেও তিনি একাকী সুবিশাল সাম্রাজ্যের শাসনরজ্জু যেভাবে নিজের হাতে ধরে রেখেছিলেন তাতে তিনি বিশেষ কৃতিত্বের দাবি করতে পারেন।

সামরিক ব্যবস্থা: সামরিক ক্ষেত্রেও সম্রাট তাঁর সেনাপতিগণের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে পারতেন না। আকবরের আমলে যে রাজপুতগণ মোগল সাম্রাজ্যের নিরাপত রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন, ঔরঙ্গজেবের ধর্মাখ নীতির ফলে সেই রাজপুতগণই মোগল সাম্রাজ্যের বিরুধে অস্ত্রধারণ করেন। সম্রাট একাকী সব সামরিক অভিযান পরিচালন করতেন। ফলে তাঁর সেনাপতিগণের কোনোরূপ দায়দায়িত্ব ছিল না।

ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা: ঔরঙ্গজেবের রাজত্বেও ভূমিরাজস্ব ছিল সাম্রাজ্যের আমেন প্রধান উৎস। ভূমিরাজস্ব ছাড়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কর ছিল ‘জিজিয়া’, ‘লবণ কর’ ও বাণিজ্য শুল্ক ইত্যাদি। কোরানে যে সমস্ত কর নিফিশ ও অবৈধ সেগুলি তিনি বাতিল করেন। বিনিময়ে তিনি হিন্দুদের ওপর তীর্থকর ও জিজিয়া আরোপ করেন।

রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি আকবরের মতোই ছিল। তবে তিনি সরাসরি প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের পরিবর্তে চুক্তিবদ্ধ আদায়কারীদের হাতে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব অর্পণ করেন। এই ব্যবস্থার ফলে প্রজাসাধারণের বিশেষত কৃষকদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠেছিল।

ঔরঙ্গজেবের চরিত্র ও কৃতিত্ব:

ঔরঙ্গজেব ভারত ইতিহাসের এক মহাবিতর্কিত চরিত্র। তাঁর ধর্মান্ধতা, অদূরদর্শিতা, অবিশ্বাস, প্রতিপক্ষের সঙ্গে নির্মম আচরণ ইত্যাদির জন্য তিনি ইতিহাসে বিশেষ সমালোচনার পাত্র হয়ে উঠেছিলেন।

* সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন: ঔরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত জীবন ছিল নানা সদ্‌গুণে ভূষিত। তিনি ছিলেন স্বধর্মনিষ্ঠ মুসলমান। তাঁর ব্যক্তিগত ধর্মমত তাঁর রাজ্য শাসননীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। ইসলামের অনুশাসনগুলি তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। সেই অনুযায়ী তিনি সকল প্রকার ঐশ্বর্য ও ভোগবিলাস বাদ দিয়ে নিতান্ত সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন।

* ধর্মীয় বিশ্বাস: স্বধর্মনিষ্ঠ মুসলিমদের কাছে তিনি ছিলেন ‘জিন্দাপীর’ (Living Saint)। পবিত্র কোরানের বিধিগুলি তিনি একান্ত আন্তরিকতার সঙ্গে অনুসরণ করতেন; এমন কি যুদ্ধক্ষেত্রে সদাব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও তাঁর নমাজ বা কোরান পাঠের কোনো ব্যতিক্রম ঘটত না। তাঁর ধর্মীয় অসহিষুতার জন্য তিনি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকগণের সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন; তিনি চাইতেন দিল্লির বাদশাহগণ হবেন কেবল ইসলামের রক্ষক এবং প্রচারক।

* হিন্দুদের প্রতি ব্যবহার: অন্যদিকে তিনি ব্রাহ্মণদের নিষ্কর জমিদান করতেন,বিদ্বজ্জনের সমাদর করতেন, এমন নজির আছে। যে সব জমিদার কৃষকদের নির্যাতনবা প্রজাপীড়ন করতেন তিনি তাঁদের শাস্তি দিতেন।

* সমদর্শিতা: পার্সিভ্যাল স্পীয়ার, রোমিলা থাপার প্রমুখ আধুনিক ঐতিহাসিকগণের মতে ঔরঙ্গজেব আকবরের ন্যায় হিন্দু ও মুসলমানের প্রতি সম মনোভাবাপন্ন ছিলেন না একথা সত্য, কিন্তু দু-চারটি ক্ষেত্র ছাড়া তাঁর হিন্দু নির্যাতনের কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। হিন্দুদের প্রতি তিনি মোটামুটি সহিষুতার আদর্শই অনুসরণ করে চলতেন। তা না হলে তাঁর পক্ষে দীর্ঘকালব্যাপী বিশাল ভারত সাম্রাজ্য শাসন করা সম্ভবপর হত না।

চরিত্রের ত্রুটি: ঔরঙ্গজেবের চরিত্রের প্রধান ত্রুটি ছিল তাঁর শঠতা, প্রবন্ধনা ও নির্মমতা। এক্ষেত্রে শুধু হিন্দুরা কেন, তাঁর পিতা শাজাহান অথবা তাঁর ভাতা বা পুত্রগণ কেউই রেহাই পাননি। পিতার বন্দিত্ব, ভ্রাতৃবর্গের হত্যা, পুত্রের প্রতি নির্মম আচরণ তাঁকে শেষ পর্যন্ত নিঃসঙ্গ করে তুলেছিল। তাঁর সন্দেহবাতিকতা ও অবিশ্বাস তাঁকে আত্মীয়- পরিজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। একাকী সাম্রাজ্যের সকল কাজ করতে গিয়ে তিনি সাম্রাজ্যের বিপদ ডেকে আনেন।

মৃত্যু ও মূল্যায়ন: জীবন সায়াহ্নেই সম্রাট তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের ঘনায়মান অন্ধকার প্রত্যক্ষ করে যান। দারার কবন্ধ, মুরাদের ছিন্ন শির, মুমূর্ষু অসহায় পিতার করুণ আর্তনাদ তাঁকে নিয়ত আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলত। এই অন্ধকার ও হতাশার মধ্যেই সম্রাট অগ্রিম শয়নে শায়িত হন। ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার তাঁর জীবনের যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন: ‘ঔরঙ্গজেবের জীবন একটি সুদীর্ঘ বেদনার কাহিনী…নিয়তির মানুষের বিফল প্রচেষ্টার করুণ ইতিহাস।’