মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা

মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা (Mogal Samrajyer Pratistha): Establishment of the Mughal Empire

মোগল আমলের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে উপাদানের প্রাচুর্য লক্ষ করা যায়। এ যুগের শাসকদের ইতিহাস সচেতনতা ছিল ব্যাপক ও গভীর। সরকারি ফরমান মোগল যুগের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন দিককে আলোকপাত করে। মোগল সম্রাটদের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থগুলি ছিল সংশ্লিষ্ট শাসকদের রাজত্বকালের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহকারী উপাদান। এই যুগের মুদ্রা ও শিল্পকীর্তি থেকে অর্থনৈতিক ও শিল্প নৈপুণ্যের দিকটি ফুটে ওঠে। এছাড়া বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ থেকেও সমকালীন নানা তথ্য পাওয়া যায়।

* মোগলদের উৎপত্তি: ভারতবর্ষে জহিরউদ্দিন মহম্মদ বাবর নামে মধ্য এশিয়ার এক চাগতাই তুর্কি নেতা কর্তৃক মোগল বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘মোঙ্গল’ শব্দটি থেকে মোগল শব্দের উৎপত্তি। বাবর ও তাঁর উত্তরসূরী ভারত ইতিহাসে মোগল বা মুঘল নামে পরিচিত।

মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর:

ভারতে প্রাথমিক অভিযান: চেঙ্গিজ খাঁ ও তৈমুর লং-এর বংশধর জহিরুদ্দিন বাবর কাবুল ও কান্দাহার অধিকার করার পর ভারত জয় করার জন্য মনস্থির করেন। আফগান লোদি বংশের শাসন দিল্লিতে কায়েম হবার আগে ভারত তুর্কিদের অধীনস্থ ছিল। বাবর নিজে তুর্কিজাতীয় ছিলেন বলে তাঁর বিশ্বাস ছিল যে ভারতের ওপর তাঁর অধিকার সংগত। ইব্রাহিম লোদির দুর্বলতা, আফগান নেতাদের মধ্যে ঐক্যের অভাব ও ইব্রাহিমের সঙ্গে রাজপুত রাজা রানা সঙ্গের বিরোধ তাঁকে ভারত আক্রমণের জন্য তৎপর করে তোলে।

শিয়ালকোট অধিকার: পাঞ্জাবের শাসক দৌলত খাঁ, ইব্রাহিমের আত্মীয় আলম খাঁ এবং রানা সঙ্গ বা সংগ্রাম সিংহ বাবরকে ভারত আক্রমণ করার জন্য গোপনে আমন্ত্রণপত্র প্রেরণ করেন। তাই বাবর দিল্লি আক্রমণ করার আগে পাঞ্জাবের শিয়ালকোট অধিকার করে নেন।

পানিপথের প্রথম যুদ্ধ: ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির কাছে অবস্থিত পানিপথের প্রান্তরে বাবর ও ইব্রাহিম লোদির সেনাবাহিনীর মধ্যে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় তা পানিপথের প্রথম যুদ্ধ নামে ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। যুদ্ধে দিল্লির আফগান সম্রাট ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করেন। উন্নত রণনীতি, নেতৃত্ব দানে নৈপুণ্য ও কামানের ব্যবহার বাবরকে দিল্লি ও আগ্রা জয় করতে সাহায্য করে। বাবর দিল্লি ও আগ্রা জয় করলেও ভারতের দুই প্রধান শক্তি আফগান জায়গিরদারগণ ও রাজপুত রাজারা বাবরকে বিতাড়িত করার চেষ্টা করেন।

পানিপথের প্রথম যুদ্ধের গুরুত্ব: পানিপথের প্রথম যুদ্ধের ফলে দিল্লির সুলতানি শাসনের অবসান হয় এবং সূচনা হয় মোগল সাম্রাজ্যের। এই যুদ্ধের অন্যতম গুরুত্ব হল ভারতে রণকৌশলের পরিবর্তন ও নতুন অধ্যায়ের সূচনা।।

খানুয়ার যুদ্ধ: রানা সঙ্গ বা সংগ্রামসিংহ ইব্রাহিম লোদির ভ্রাতা মামুদ লোদিকে দিল্লির সুলতান হিসাবে ঘোষণা করেন। কিন্তু ইতিমধ্যে বাবর কাবুলে ফিরে না গেলে রানা হতাশ হয়ে পড়েন। তিনি আফগানদের সঙ্গে ঐক্যবধ হয়ে তাঁকে ভারত থেকে বহিষ্কার করার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে খানুয়ার যুদ্ধে বাবর তাঁর রণকুশলতা ও কামানের ব্যবহার করে দুর্ধর্ষ যোধা রাজপুতদের পরাজিত করেন। এরপর তিনি মালবের অন্তর্গত চান্দেরি দুর্গটি অধিকার করেন। মেওয়াটও বাবরের অধীনস্থ হয়।

গোগরার যুদ্ধ: মামুদ লোদির নেতৃত্বে উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের আফগানগণ সংঘকধ হয়। বাংলার স্বাধীন সুলতান নসরত শাহ তাদের সঙ্গে যোগ দেন। বাবর কূটনীতির সাহায্যে নসরত শাহকে নিরপেক্ষ রাখতে সমর্থ হন। বিহারের কিছু আফগান সর্দারও বিনা যুদ্ধে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেন। ১৫২৯-এ গোগরা-র যুদ্ধে বাবর আফগানদের পরাজিত করায় বিহারের বড়ো অংশে তাঁর প্রাধান্য স্থাপিত হল।

বাবরের চরিত্র ও কৃতিত্ব:

বাবরের সাফল্য: ক্ষুদ্র এক রাজ্যের অধিপতি হয়েও বাবর নিজ বীরত্ব এবং সামরিক প্রতিভাবলে ভারতে এক বিশাল সাম্রাজ্যের সূচনা করেছিলেন। তিনি ছিলেন বহুগুণসম্পন্ন, বহুমুখী প্রতিভাশালী, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, কঠোর পরিশ্রমী এক পুরুষ।

তাঁর জীবনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁকে সারাজীবন কঠোর সংগ্রামে লিপ্ত রেখেছিল এবং শেষপর্যন্ত তিনি সাফল্যও অর্জন করেছিলেন।

* ব্যাক্তিগত গুণাবলি: ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন সদাশয়, উদার ও স্নেহপরায়ণ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সঙ্গীত এবং সাহিত্যের প্রতি তাঁর সহজাত অনুরাগ ছিল। ধর্মের প্রতিও তাঁর অনুরাগ ছিল প্রবল; তবে তিনি ধর্মান্ধ ছিলেন না। তিনি ছিলেন বন্ধু বৎসল,পুত্রের প্রতি স্নেহপরায়ণ এবং গুণগ্রাহী সম্রাট।

বাবরের আত্মজীবনীমূলক রচনা: বাবর রচিত আত্মজীবনী ‘বাবর নামা’সমসাময়িককালের একখানি মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল। মূলগ্রখখানি তুর্কি ভাষায় রচিত। গ্রথখানি থেকে সমকালীন ভারতবর্ষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থার প্রামাণ্য বিবরণ পাওয়া যায়। বিশেষত বাবরের জীবনের খুঁটিনাটি ঘটনাবলি, সেকালের ভারত, আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়া সম্পর্কে বিস্তর তথ্য অবগত হওয়া যায়। এছাড়া বাবরের চরিত্রের বিশেষত্বগুলি যেমন তাঁর প্রখর ব্যক্তিত্ব, নৈতিক উৎকর্ষ এবং রণনৈপুণ্য গ্রন্থখানিতে পরিস্ফুট।

গ্রন্থখানির জনপ্রিয়তা: গ্রথখানিরবাবররচনাভঙ্গি সাবলীল, ভাষা সরল এবং সহজবোধ্য। ঐতিহাসিক লেনপুল গ্রখখানির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেছেন, ‘বাবরের প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ ও তাঁর গৌরব অস্তমিত হয়েছে বটে, কিন্তু তাঁর আত্মস্মৃতি আজও অমর ও অক্ষয় হয়ে আছে।’ বাস্তবিকই মধ্য এশিয়ার কোনো রাজা বা সম্রাট সম্ভবত এমন উচুমানের সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেননি।

* বৈদেশিক সম্পর্ক: বাবরের সময় থেকে আফগানিস্তান দীর্ঘকাল যাবৎ মোগলদের অধীনে থাকায় মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া এবং চিনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়, বৈদেশিক আক্রমণের ভীতিরও অবসান ঘটে।

* সাহিত্য-সংগীতের পৃষ্ঠপোষক: সাহিত্য, শিল্প ও সংগীতের পৃষ্ঠপোষকতা করে তাঁর বংশধরদের সামনে অনুকরণযোগ্য আদর্শ রেখে যান। বাবরের আত্মচরিত, তুর্কিভাষায় রচিত ‘তুজুক-ই-বাবরি’ একটি অত্যন্ত উপাদেয় ও মূল্যবান গ্রন্থ। তিনি তাঁর উত্তরাধিকারীদের ভারতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে ও তাঁর দ্বারা স্থাপিত মোগল রাজ্যের সম্প্রসারণ ঘটাতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।

* মূল্যায়ন: ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে বাবর মৃত্যুমুখে পতিত হন। পশ্চিম ভারতে তখনও দুর্দান্ত আফগানদের আধিপত্য ছিল। রাজপুতরাও তাদের ক্ষমতা হারায় নি। তার সঙ্গে বাংলাও স্বাধীন ছিল। বিহারেও আফগান শক্তি একেবারে লুপ্ত হয়নি। তবুও বাবর উত্তর ভারতে মোগলদের কর্তৃত্ব বেশ সুদৃঢ় করতে সমর্থ হন। তাঁর সমসাময়িক বা পরবর্তী কোনো মোগল অভিজাত নিজেকে বাবরের সমকক্ষ বলে জাহির করার সাহস করতেন না।

মোগল-আফগান প্রতিদ্বন্দ্বিতা

■ হুমায়ন (১৫৩০-৪০; ১৫৫৫-৫৬ খ্রিঃ):

বাবরের অকালমৃত্যু ঘটলে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসাবে একমাত্র পুত্র হুমায়ুন দিল্লির সিংহাসনে বসেন। ‘হুমায়ন’ শব্দের অর্থ ভাগ্যবান। কিন্তু বাবরের জ্যেষ্ঠ পুত্র হুমায়নের জীবনে দুর্ভাগ্য ছিল চিরসঙ্গী।

মোগল ও আফগান প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূচনা: ক্ষমতালাভের পর গুজরাটের আফগান শাসক বাহাদুর শাহ বাংলার সুলতান নসরত শাহ এবং বিহারের আফগান জাতি তাঁর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। বিহারের চুনার দুর্গের অধিপতি আফগান বীর শের খাঁ চুপচাপ নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করছিলেন। বাহাদুর শাহ মালব ও চিতোর অধিকার করে নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন। এর ফলে মোগল ও আফগান প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়ে যায়।

দাদরা যুদ্ধ: বিহারের আফগানেরা মামুদ লোদির পরিচালনায় জোটকধ হয়ে পশ্চিমদিকে এগিয়ে গেলে হুমায়ুন ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে দাদরা- র যুদ্ধে তাদের হারিয়ে দেন। এরপর তিনি চুনার দুর্গটি অধিকার করলে শের খাঁ মৌখিকভাবে হুমায়ুনের বশ্যতা স্বীকার করে। নিষ্কৃতি পান।

হুমায়ন ও বাহাদুর শাহ: পরবর্তী পদক্ষেপে হুমায়ুন বাহাদুর শাহের দিকে এগিয়ে যান। আফগানদের অধিকারভুক্ত বেয়ানা প্রদেশ মোগল সৈন্যরা উধার করে ও গুজরাটে হানা দেয়। বাহাদুর শাহ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পালিয়ে যেতে থাকেন। তাঁর পেছনে ধাওয়া করে হুমায়ুন মালব, চম্পানির, আহম্মদনগর ও মাণ্ডু প্রদেশ নিজের অধিকারে আনেন।

বাহাদুর শাহের মৃত্যুবরণ: হুমায়ন শেষ পর্যন্ত বাহাদুর শাহকে ধরতে পারলেন না। হুমায়ুন তাঁর ভাই আসকারীকে গুজরাটের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে মাণ্ডুতে যান। এদিকে দুর্বল আসকারীকে অপসারিত করে বাহাদুর শাহ আবার গুজরাট দখল করে নেন। মালব প্রদেশটিও হুমায়ুন বাধ্য হয়ে হাতছাড়া করেন। ইতিমধ্যে পোতুর্গিজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাহাদুর শাহ মৃত্যুবরণ করলে হুমায়ুন আশ্বস্ত হন।

শের খাঁর প্রতাপ: বাংলার সুলতান ও বিহারের শের খাঁ-বিরোধী আফগানদের একটি জোটকে পরাজিত করে শের খাঁ নিজের ক্ষমতা ও মর্যাদার বৃদ্ধি ঘটান। প্রচুর সম্পদ ও একটি গোলন্দাজ বাহিনী তাঁর হাতে আসে। এরপর তিনি বেশ কয়েকবার বাংলা আক্রমণ করলে বাংলার সুলতান বাধ্য হয়ে হুমায়ুনের শরণ নেন।

শের খাঁর বাংলা ত্যাগ: ওদিকে হুমায়ুনও শের খাঁর শক্তিবৃদ্ধিতে মনে মনে সন্দিগ হয়ে উঠছিলেন। তিনি চুনার দুর্গ অধিকার করে নিলেও শের খাঁ বিন্দুমাত্র শক্তিক্ষয় না ঘটিয়ে বাংলার ক্ষমতা দখল করে প্রভূত সম্পদের অধিকারী হওয়া হুমায়ুনের চোখে বিসদৃশ লাগে। হুমায়ুন বাংলায় এসে পৌঁছালে শের খাঁ বাংলা ত্যাগ করে পশ্চিম অভিমুখে অগ্রসর হন এবং বারাণসী ও জৌনপুর অধিকার করেন এবং কনৌজ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে ব্যাপক লুণ্ঠন চালান।

হুমায়নের পারস্য পলায়ন: বাংলায় দীর্ঘ নয় মাস ধরে হুমায়ুন বিলাস-ব্যসনে অতিবাহিত করে অবশেষে বিপদ বুঝে আগ্রা অভিমুখে রওনা দেন। পথিমধ্যে চৌসা-র যুদ্ধে (১৫৩৯ খ্রিঃ) হুমায়ুন পরাজিত হন ও প্রাণভয়ে পলায়ন করেন। শের খাঁ এই যুদ্ধের পর ‘শেরশাহ’ উপাধি নিয়ে নিজের নামাঙ্কিত মুদ্রা ‘প্রচলন করেন।

বিলগ্রামের যুদ্ধ: হুমায়ুন আগ্রায় ফিরে নতুন করে সৈন্যসংগ্রহ করে আবার শেরশাহের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে বিলগ্রামের যুদ্ধে শেরশাহ হুমায়ূনকে শোচনীয়ভাবে হারিয়ে দেন। পরাজিত হুমায়ুন আগ্রার দিকে এগিয়ে গেলে শেরশাহের সেনাবাহিনী তাঁর পেছনে ধাওয়া করে। ভারতের কোথাও নিজের নিরাপত্তা রক্ষা করতে না পেরে হুমায়ুন পারস্যে পলায়ন করেন। ভারতের নতুন অধিপতি হন শেরশাহ।

■ শেরশাহ (১৫৪০-১৫৪৫ খ্রিঃ):

বাল্যজীবন: শেরশাহের আসল নাম ছিল ফরিদ খাঁ। পিতা হাসান শূর ছিলেন বিহারের অন্তর্গত সাসারামের একজন জায়গিরদার। বিমাতার চক্রান্তে ফরিদকে অতি অল্প বয়সেই গৃহত্যাগ করে জৌনপুরে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়। সেখানে তিনি আরবি ও ফারসিভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। সন্তুষ্ট পিতা তাঁকে গৃহে ফিরিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু বিমাতার চক্রান্তে ফবিদ পুনরায় বিতাড়িত হন। *

শের খাঁ উপাধি লাভ: শের খাঁ বিহারের সুলতান বাহার খাঁর অধীনে কর্মগ্রহণ করেন। স্বহস্তে একটি বাঘ (শের) শিকার করে তিনি বাহার খাঁর কাছ থেকে শের খাঁ উপাধি পান। বাহার মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র জালাল খাঁর অভিভাবক নিযুক্ত হন। এর কিছু পরে তিনি চুনার দুর্গের অধিপতির বিধবা পত্নীকে বিবাহ করে ওই দুর্গসহ প্রভূত ধনসম্পদ লাভ করেন।

রাজ্যবিস্তার: দিল্লির সিংহাসন দখলের পর শের খাঁ রাজ্যবিস্তারে অগ্রসর হন। একে একে পাঞ্জাব, সিন্ধু, মূলতান, মালব দুর্গ তাঁর অধিকারে আসে। রাজপুতানার চিতোরও তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু বুন্দেলখণ্ডের কালিঞ্জর দুর্গ জয় করতে গিয়ে এক বিস্ফোরণের ফলে তাঁর মৃত্যু হয় (১৫৪৫ খ্রিঃ)।

শাসক হিসাবে শেরশাহের কৃতিত্ব:

মধ্যযুগে অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক শেরশাহ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি কেবল সাহসী বীর যোদ্ধাই ছিলেন না, শাসক হিসাবেও তিনি সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালের বেশিরভাগ সময় যুদ্ধ বিগ্রহে কাটালেও সাম্রাজ্যের সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা স্থাপনে কোনো ত্রুটি করেননি।

*সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি: শেরশাহ মাত্র ৫ বছর রাজত্ব করেন। তাঁর সাম্রাজ্য পূর্বদিকে পূর্ববঙ্গে-র সোনারগাঁও থেকে উত্তর-পশ্চিমে পাঞ্জাব পর্যন্ত এবং উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্বত পর্যন্ত প্রসারিত হয়।

শাসক হিসাবে শেরশাহ: শাসক হিসাবে শেরশাহ স্বৈরতান্ত্রিক হলেও তাঁর স্বৈরতন্ত্র ছিল উদারনৈতিক। তিনি নিজেকে জনগণের অভিভাবক বলে মনে করতেন। ধর্মনিরপেক্ষতাই ছিল তাঁর শাসনব্যবস্থার মূল ভিত্তি।

কেন্দ্রীয় শাসন: শাসনব্যবস্থার সর্বোচ্চে ছিলেন স্বয়ং সুলতান। তাঁকে সাহায্য করার জন্য চারজন মন্ত্রী ছিলেন। উজিরাত হলেন প্রধানমন্ত্রী। রাজ্যের আয় ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও অন্য মন্ত্রীদের কাজের তদারকি করা তাঁর দায়িত্ব ছিল। অন্যান্য মন্ত্রীরা বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন।

স্থানীয় শাসন: শাসনকার্যের সুবিধার জন্য শেরশাহ তাঁর সাম্রাজ্যকে ৪৭ টি সরকারে বিভত্ত করেন। একএকটি সরকার আবার কয়েকটি পরগণায় বিভক্ত ছিল। পরগণাগুলি ছিল কতকগুলি গ্রামে বিভক্ত। গ্রামের শাসন স্থানীয় পঞ্চায়েতের উপর ন্যস্ত ছিল।

সামরিক ব্যকথা: শেরশাহের সেনাবাহিনী অশ্বারোহী, পদাতিক ও গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে গঠিত ছিল। সুলতান ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান। সৈন্যদের নগদ বেতন দেওয়া হত। নানা স্থানে সেনা নিবাস ছিল। যোগ্যতা অনুযায়ী সেনা নিয়োগ হত। হিন্দু সেনাপতি ব্রমজিৎ গৌর ছিলেন বিখ্যাত।

বিচার ব্যবস্থা: শেরশাহ বিচারের ক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্র ও হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করতেন না। তিনি ছিলেন ন্যায় বিচারক। দন্ডবিধি খুব কঠোর ছিল।

* ভূমি সংস্কার: শেরশাহ সাম্রাজ্যের সমস্ত জমি জরিপ করে প্রজাগণের জমির সীমানা ঠিক করে দেন এবং রায়তকে তাঁর স্বত্ব রক্ষার পাট্টা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং রায়তও নির্ধারিত রাজস্ব দানে অলীকার করে কবুলিয়ত লিখে দিত।

*রাজস্ব সংস্কার: শেরশাহ জমির উৎপাদনের ভিত্তিতে রাজস্ব নির্ধারণ করেন। জমির উৎপন্ন ফসলের এক-তৃতীয়াংশ বা এক-চতুর্থাংশ রাজস্ব হিসেবে নির্দিষ্ট হল। আমিন, মুকন্দম, কানুনগো, পাটোয়ারী প্রভৃতি কর্মচারীরা রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে থাকলেও প্রজাবর্গ সরাসরি উৎপন্ন শস্যে অথবা নগদ অর্থে রাজকোষে রাজস্ব জমা দিতে পারত।

জনহিতকর ব্যবস্থা: সুলতান ছিলেন জনদরদী শাসক। যাতায়াতের জন্য গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের সংস্কার করেন। রাস্তার দু’পাশে সরাইখানা নির্মাণ করেন। ব্যাবসা- বাণিজ্যের জন্য সোনা, রূপা ও তামার মুদ্রার প্রচলন করেন। ঘোড়ার ডাকের ব্যকথা শেরশাহই প্রথম প্রচলন করেন।

মোগল শাসনের পুনঃপ্রতিষ্ঠা:

শেরশাহের উত্তরাধিকারীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে হুমায়ুন ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে লাহোর অধিকার করে নেন। তারপর তিনি দুটি আফগান বাহিনীকে পরাস্ত করে দিল্লি ও আগ্রা অধিকার করেন। অবশিষ্ট আফগান ক্ষমতাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার আগেই ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থাগারের সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে হুমায়ুনের অতর্কিত মৃত্যু ঘটে। হুমায়ুনের মৃত্যুর পর পাঞ্জাবে অবস্থানরত তাঁর নাবালক পুত্র আকবর মোগল সম্রাট বলে ঘোষিত হন।