খলজি শাসনের সূত্রপাত

☆ খলজি শাসনের সূত্রপাত (Khalaji Sasaner sutrapat): Beginning of Khalji rule

কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে খলজিগণ তুর্কি জাতীয় ছিল না। তারা ছিল আফগান, পরে দীর্ঘকাল হিন্দুস্তানে থাকায় তারা হিন্দুস্তানি নামে পরিচিত হয়। খলজিদের ক্ষমতা দখলের ফলে সুলতানি রাজ্যে তুর্কি আমিরদের একচেটিয়া কর্তৃত্বের অবসান এবং হিন্দুস্তানিরাও উচ্চ সরকারি পদে নিযুক্ত হবার অধিকার পায়।

■ জালালউদ্দিন ফিরুজ :

বলবনের মৃত্যুর (১২৮৭ খ্রিঃ) পর তাঁর পৌত্র কায়কোবাদ সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁর শিশুপুত্র কায়ুর্মাসকে সিংহাসনে বসান হয় (১২৮৯ খ্রিঃ)। এসময় বলবনের উত্তরাধিকারীদের অযোগ্যতার সুযোগ নিয়ে সামানার শাসনকর্তা খলজি বংশীয় জালালউদ্দিন ফিরুজ (১২৯০-১২৯৬) দিল্লির সিংহাসন দখল করেন।

জালালউদ্দিনের শাসনকার্য ও খলজি বিপ্লব: খলজি যুগে বিশেষ করে জালালউদ্দিনের উত্তরাধিকারী আলাউদ্দিন খলজির রাজত্বকালে বহুকাল পর সাম্রাজ্যবিস্তারের কাজ শুরু হয়। দক্ষিণ ভারতসহ প্রায় সমগ্র ভারত খলজিদের পদানত হয়। শাসনকার্যে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে। সুলতানের ওপর শরিয়তী আইন ও উলেমা সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণ কার্যত উঠে যায় এবং নানা জ্ঞানীগুণীর সমাবেশ ঘটায় রাজসভা আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। এসব ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনা করেই ঐতিহাসিকগণ খলজিদের ক্ষমতা দখলকে ‘খলজি বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেছেন।

* ‘নব মুসলমান’: কৃষ্ণ সুলতান জালালউদ্দিন খলজি অত্যন্ত ক্ষমাপ্রবণ ও শান্তিপ্রিয় প্রকৃতির ছিলেন। মোগলদের পরাস্ত করার পর যে সমস্ত মোগলরা তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল তাদের তিনি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে দিল্লির উপকণ্ঠে বসবাস করার বন্দোবস্ত করে দেন। এরাই ইতিহাসে ‘নব মুসলমান‘ নামে পরিচিতি লাভ করে।

* দেবগিরি লুণ্ঠন: সুলতানের ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা, কারা মানিকপুরের শাসক আলাউদ্দিন খলজি সুলতানের অনুমতির অপেক্ষা না করেই দাক্ষিণাত্যের হিন্দু যাদবরাজ্যের রাজধানী দেবগিরি লুঠ করেন। দেবগিরি থেকে প্রাপ্ত প্রচুর সোনা-রূপো- মণি-মুস্তো ও রেশমি বস্ত্র প্রভৃতি লুণ্ঠন করে নিয়ে যান।

* জালালউদ্দিনের মৃত্যু: বৃদ্ধ সুলতান জালালউদ্দিন আলাউদ্দিনের ভ্রাতা উলুখ খাঁয়ের পরামর্শ অনুযায়ী ‘অনুতপ্ত’ আলাউদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে মানিকপুরে গেলে আলাউদ্দিনের ইশারায় তাঁর প্রাণ হরণ করা হয়। এরপর ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে নিজেকে সুলতান বলে ঘোষণা করেন আলাউদ্দিন খলজি।

আলাউদ্দিন খলজি (১২৯৬-১৩১৬ খ্রি.)চরম বিশ্বাসঘাতকতার সাহায্যে দিল্লির সিংহাসনে বসেন আলাউদ্দিন খলজি। সিংহাসনে আরোহণ করেই তিনি প্রথমে উচ্চপদের লালসা ও প্রচুর অর্থ দিয়ে জালালউদ্দিনের কয়েকজন আমিরকে নিজের পক্ষে টেনে নেন। তাঁর বিরুদ্ধে চারটি বিদ্রোহ সূচিত হলে ভবিষ্যতে যাতে আর কোনো বিদ্রোহ দেখা না দেয় সেজন্য তিনি কয়েকটি ব্যকথা নেন।

ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করা: অভিজাতশ্রেণি ও সম্পন্ন ব্যক্তিদের ক্ষমতাকে খর্ব করার জন্য তিনি দান করা সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। তার সঙ্গে রাজস্ব সংগ্রাহকদের নির্দেশ দেন, প্রজাদের কাছ থেকে বাড়তি সম্পদ ও অর্থ কেড়ে নিতে। অসংখ্য গুপ্তচর নিয়োগ করে অভিজাতশ্রেণি ও সাধারণ প্রজাদের চালচলন ও চিন্তাভাবনা সন্ধানআলাউদ্দিন খলজিকরার ব্যবস্থা গ্রহণ করে আলাউদ্দিন ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

অভ্যন্তরীণ সংস্কারসাধন: অভিজাতশ্রেণির মেলামেশা, প্রকাশ্যে মদ্যপান ও তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে তিনি বিদ্রোহের আশঙ্কাকে দূরীভূত করেন। আলাউদ্দিনের রাজত্বকালে মোগল আক্রমণ ঘন ঘন ঘটতে থাকে। তিনি একই সঙ্গে মোগলদের আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকেন ও রাজ্যবিস্তারের দিকে মন দেন। এজন্য এক বিশাল সৈন্যবাহিনী ও তাদের ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য প্রয়োজন ছিল একটি পরিপূর্ণ রাজকোশাগার।

■ আলাউদ্দিন খলজির রাজস্বব্যবস্থা:

* নির্দিষ্ট ভূমি রাজস্ব: সুলতান প্রজাদের উৎপন্ন ফসলের শতকরা ৫০ভাগ রাজস্ব হিসাবে আদায় করতে থাকেন। এছাড়াও প্রজাদের গৃহকর, চারণকর, বাণিজ্যশুল্ক প্রভৃতি দিতে হত। রাজ্যের কিছু অংশে জমি জরিপ করে ভূমি রাজস্ব নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়।

* দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ: আলাউদ্দিনের সময় রাজ্যে খাদ্যশস্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম ঘনঘন বৃদ্ধি পেত। এর ফলে বেতনবৃদ্ধির জন্য দাবি জানানো সৈন্যদের পক্ষে অস্বাভাবিক ছিল না। এই জন্য সুলতান জিনিসপত্রের দাম বেঁধে দেন এবং দিল্লিতে স্থাপিত ন্যায্য মূল্যের বাজারগুলিতে পণ্যাদি সরবরাহের জন্যও সুষ্ঠু ব্যবথা করেন। উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের সুলতান-নির্দিষ্ট মূল্যে কেনাবেচা করতে বাধ্য করেন। সুলতানের নির্দেশ লঙ্ঘনকারীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হত। সুলতান দিল্লির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহ থেকে শস্যে রাজস্ব আদায় করে তা শস্যের গুদামে রেখে দিতেন। অনটনের সময় তা জনগণের মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণে বিক্রি করা হত।

* মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস: রাজধানীতে বহু লোকের সমাগম হওয়ায় স্বাভাবিক কারণেই সেখানে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিত। জিনিসপত্রের দরদাম বেঁধে দিয়ে সুলতান তা হ্রাস করতে চেয়েছিলেন। আমির খুসবু প্রভৃতির মতে, জনসাধারণের কল্যাণসাধনের জন্যই তিনি এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কিন্তু সমগ্র সাম্রাজ্যে তা কার্যকর করা হয়নি।

রাজস্ব সংস্কার: আলাউদ্দিনের কঠোর বিধিনিষেধের ফলে অভিজাতবর্গের ক্ষমতা অবশ্যই খর্বিত হয়েছিল এবং বিদ্রোহের আশঙ্কা হ্রাস পাওয়ায় দেশে শান্তি-শৃঙ্খলাও খাপিত হয়েছিল। তাঁর রাজস্ব-সংস্কারের ফলে কোশাগার স্ফীত হয় এবং মোগল আক্রমণ প্রতিরোধ এবং প্রায় সমগ্র ভারতে সুলতানের প্রাধান্য স্থাপন দুই-ই কার্যকর হয়। কেউ কেউ বলেন, ভারতে আলাউদ্দিনই প্রথম জমি জরিপ করেছিলেন। কিন্তু ইউ. এস. ঘোষালের মতে, প্রাচীন ভারতে জমি জরিপের ব্যকথা ছিল।

■ আলাউদ্দিন খলজির শাসনসংস্কার:

শাসনসংস্কারে সীমাবদ্ধতা: সুলতানের শাসন-সংস্কার অবশ্য ত্রুটিহীন ছিল না।অভিজাত শ্রেণি তাঁর প্রতি অতিশয় বিদ্বেষভাবাপন্ন ছিল। অত্যন্ত চড়া হারে রাজস্ব ধার্য হওয়ায় এবং তা কঠোরভাবে আদায় করায় প্রজাদের নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল। রাজস্ব- সংগ্রাহকদের প্রতি তাঁর নীতি ছিল মাত্রাতিরিক্ত কঠোর। এর ফলে প্রধানত হিন্দুরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ রাজস্ব প্রদানকারীদের অধিকাংশ ছিল হিন্দু।

* সুলতানের প্রতি বীতশ্রদ্ধা: এভাবে সুলতানের নীতি ও কার্যকলাপের ফলে তাঁর সাম্রাজ্যের প্রায় সর্বশ্রেণির মানুষ সুলতানের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। এজন্যই বলা হয়ে থাকে যে, আলাউদ্দিনের সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল চোরাবালির ওপর, জনগণের সহযোগিতা ও সমর্থনের শক্তপোক্ত ভিত্তির ওপর নয়।

■ আলাউদ্দিনের রাজনৈতিক আদর্শ:

* নিরঙ্কুশ স্বৈরাচারী শাসক: আলাউদ্দিন ছিলেন একজন নিরঙ্কুশ স্বৈরাচারী শাসক। তিনি সুলতানের দৈব অধিকারে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি রাজতন্ত্রকে সর্বপ্রকার নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তিনি অভিজাতশ্রেণির ক্ষমতা খর্ব করেই নিশ্চেষ্ট ছিলেন না। রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে শরিয়তের আইন ব্যাখ্যাকারী উলেমা সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপও তিনি বরদাস্ত করতে রাজি ছিলেন না।

* রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা রক্ষা: আলাউদ্দিন বলেছিলেন যে, ‘আমি জানি না কোনটি আইনসিদ্ধ বা কোল্টিন্ট বেআইনি। রাষ্ট্রের পক্ষে যা কল্যাণকর বলে মনে হবে অথবা – আপৎকালে যা উপযুক্ত বলে মনে হয়, আমি তা-ই জরুরি ক্ষেত্রে কার্যকর করার জন্য – আদেশ জারি করি। শেষ বিচারের দিনে আমার ভাগ্যে কী ঘটবে, তা আমি জানি না’।

ধর্মনিরপেক্ষতা: অনেকে আলাউদ্দিনকে ধর্মনিরপেক্ষ শাসক বলার পক্ষপাতী। কিন্তু । মোগল সম্রাট মহামতি আকবর যে অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ, আলাউদ্দিন সে অর্থে কখনোই ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না। উলেমাগণ হিন্দুদের প্রতি বর্বরোচিত আচরণ করার কথা বললে তিনি রীতিমতো পুলকিত হতেন। আসলে আলাউদ্দিনের ধর্মনিরপেক্ষ হবার কোনো বাসনা ছিলনা। নিজের স্বৈরতন্ত্রকে নিরঙ্কুশ করার জন্যই তিনি উলেমাদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে নিজের বিচার-বিবেচনা মতো তাঁর রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করতেন।

* মোগলদের হানা: আলাউদ্দিনের রাজত্বকালে মোগলগণ মোট ১১ বার তাঁর রাজ্যে হানা দেয়। দুই-এক বার তারা রাজধানী দিল্লির উপকণ্ঠে এসেও হানা দেয়। সুলতান নিজে এবং তাঁর সুযোগ্য সেনাপতি জাফর খাঁ, গাজি মালিক প্রভৃতি প্রায় প্রতিবারই মোগলদের বিতাড়িত করেন। সুলতান হাজার হাজার মোগলদের বন্দি করে তাদের নির্বিচারে হত্যা করেন।

* মোগল প্রতিরোধ ও মর্যাদা বৃদ্ধি: সেনাপতি গাজি মালিক পাঞ্জাবে এক বিশাল বাহিনী মোতায়েন রাখেন এবং সীমান্ত অঞ্চলকে সুরক্ষিত করে তোলেন। তিনি কাবুল, কান্দাহার ও গজনিতে বারবার আক্রমণ চালিয়ে সেখানকার মোগলদের দুর্বল করে দিয়েছিলেন। মোগল আক্রমণ প্রতিহত করায় ভারতে আলাউদ্দিনের মর্যাদা ও ক্ষমতা প্রায় গগনচুম্বী হয়ে ওঠে। তাঁর আত্মবিশ্বাসও বহুগুণে বেড়ে যায়।

■ আলাউদ্দিনের উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সামরিক অভিযান:

চিতোর অধিকার: আলাউদ্দিন দিগ্বিজয়ী ছিলেন। তাঁর মুদ্রায় নিজেকে দ্বিতীয় সিকান্দর বা আলেকজান্ডার বলে ঘোষণা করতেন। সুলতানের দুই সেনাপতি উলুখ বাঁ ও নসরত খাঁ প্রথমে পশ্চিম ভারতের বাণিজ্যসমৃদ্ধ গুজরাট রাজ্যটি দখল করেন। এরপর বীর হান্নিরকে পরাজিত করে দুর্ভেদ্য দুর্গ রণথম্ভোর দখল করা হয়। সুলতান ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে রত্নসিংহ বা রতনসিংহকে পরাজিত করে মেবারের রাজধানী চিতোরদখল করেন। ১৩০৫ খ্রিস্টাব্দে মালব তাঁর রাজ্যভুক্ত হয়।

* দাক্ষিণাত্য জয়: সুলতান দাক্ষিণাত্য ও দক্ষিণ ভারত জয়ের জন্য সামরিক অভিযান পাঠান। তাঁর সেনাপতি মালিক কাফুর দেবগিরির রাজা রামচন্দ্রকে সুলতানের নিকট কর প্রেরণ করতে বাধ্য করেন। এরপর বরঙ্গলের কাকতীয়রাজ প্রতাপরুদ্রদেব কাফুরের নিকট পরাজিত হয়ে সুলতানকে কর দিতে স্বীকৃত হন।

সেনাপতি মালিক কাফুরের মাদুরা লুণ্ঠন: ১৩১০-এ কাফুর অতর্কিতে দোরসমুদ্র রাজ্যটি আক্রমণ করে তার রাজা তৃতীয় বীর বল্লালকে পরাজিত করেন। ১৩১১ খ্রিস্টাব্দে কাফুর পাণ্ড্যরাজ্যের রাজধানী মাদুরা লুণ্ঠন করেন। কথিত আছে, তিনি সেতুবখ রামেশ্বরম পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু অনেকে এটি সত্য বলে মনে করেন না।

* হোয়সল রাজ্য লুণ্ঠন: ১৩১৩ খ্রিস্টাব্দে দেবগিরির রাজা রামচন্দ্রের পুত্র ও উত্তরাধিকারী সিংঘন (শংকর নন) সুলতানকে কর দেওয়া বন্ধ করলে কাফুর তাঁকে পরাজিত ও নিহত করেন। মালিক কাফুর দ্বিতীয়বার হোয়সল রাজ্য লুণ্ঠন করেন। দক্ষিণ ভারত থেকে কাফুর যে সম্পদ লুণ্ঠন করেন সুলতান মামুদের নিকটেও তা অকল্পনীয় ছিল।

* কৃতিত্ব: প্রায় সমগ্র উত্তর ভারত জয় করে আলাউদ্দিন এক অসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারী হন। দিল্লির সুলতানদের মধ্যে তিনিই প্রথম দাক্ষিণাত্যের এক বিরাট অংশ নিজের অধিকারে এনেছিলেন। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবে আলাউদ্দিন সাহিত্য ও শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর দরবারে আমির খুসবু, কবি আমির হাসান এবং আরও বহু জ্ঞানীগুণী ছিলেন। আমির হাসানকে বলা হত ‘ভারতের স্যাদি’। তাঁর আমলের খাপত্যকর্মের মধ্যে আলাই দরওয়াজা, হাজার স্তস্তবিশিষ্ট প্রাসাদ, বেশ কয়েকটি দুর্গ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

* আলাউদ্দিনের মৃত্যু ও অন্যান্য উত্তরাধিকারীগণ: ১৩১৬ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিনের মৃত্যু হয়। মালিক কাফুর কিছুদিনের জন্য শাসনক্ষমতা হস্তগত করেন। শীঘ্রই তাঁকে হত্যা করে সিংহাসনে দখল করেন আলাউদ্দিনের পুত্র কুতুবউদ্দিন মুবারক (১৩১৬-১৩২০ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি পিতার কঠোর বিধি-বিধানগুলি শিথিল করে দেন। কিন্তু তাঁর অতিরিঃ খ্রিস্টানদন্ত ও লাম্পট্যে অভিজাতবর্গ ও জনসাধারণ তাঁর প্রতি বীতশ্রুধ হয়ে ওঠে। এ সুযোগে তাঁর প্রিয়পাত্র, ধর্মান্তরিত হিন্দু খুসরু তাঁকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন। শীঘ্রই দীপালপুরের শাসনকর্তা গাজি মালিক খুসবুকে হত্যা করে গিয়াসুদ্দিন তুঘলক নাম নিয়ে দিল্লির সিংহাসনে বসেন। এইভাবে দিল্লিতে তুঘলক বংশ স্থাপিত হয়।

■ গিয়াসউদ্দিন তুঘলক (১৩২০-১৩২৫ খ্রি.):

তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠাতা গিয়াসউদ্দিন তুঘলক পাঁচ বছরের রাজত্বকালে যথেষ্ট। কৃতিত্ব দেখান। তাঁর শাসনকালে সাম্রাজ্যে শাস্তি ফিরে আসে, কৃষি ও ডাক ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয় এবং বিচার, পুলিশ ও সেনাবিভাগের সংস্কার করা হয়। সুলতান বরঙ্গলও বঙ্গদেশে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর পুত্র জৌনা খাঁর চক্রান্তেই গিয়াসউদ্দিনের মৃত্যু ঘটে বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। জৌনা খাঁ মহম্মদ বিন তুঘলক নাম ধারণ করে সিংহাসনে বসেন।

মহম্মদ বিন তুঘলক (১৩২৫-১৩৫১ খ্রি.):

গিয়াসউদ্দিনের মৃত্যুর পর জুনা খাঁ বা মহম্মদ বিন তুঘলক দিল্লির সিংহাসনে বসেন। শাসনের শুরুতে তিনি বেশ কয়েকটি বিদ্রোহ দমন করেন এবং হোয়সল ও নগরকোট রাজ্য জয় করে সাম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি করেন। তাঁর শাসনকালে আগত বিদেশি পর্যটক ইবন বতুতার লেখা ‘কিতাব-উর-রাহলা’ গ্রুথ থেকে সে যুগের নানা তথ্য পাওয়া যায়।

রাজনৈতিক আদর্শ: মহম্মদ ছিলেন প্রচণ্ড উচ্চাকাঙ্ক্ষী, কট্টর সাম্রাজ্যবাদী, নিরঙ্কুশ স্বৈরতন্ত্রের সমর্থক, সারা ভারতে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্য স্থাপনে আগ্রহী, ধর্মীয় ব্যাপারে যুক্তিবাদী এবং সকল ধর্মমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তিনি রাজকীয় শক্তির ওপর অভিজাত ও উলেমাদের হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করতে রাজি ছিলেন না। তিনি উন্নত অভিজাতদের বাদ দিয়ে সাধারণ ঘরের সুযোগ্য ‘হিন্দু- মুসলমানদের সরকারি পদে নিযুক্ত করে তাঁর ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল একটি আমলা সম্প্রদায় গড়ে তোলেন।

যুক্তিবাদী মুসলমান: বরণী ও ইসামির মতো গোঁড়া মুসলিম ঐতিহাসিকগণ মহম্মদকে বিধর্মী বা হিন্দু-ঘেঁষা বললেও তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী মুসলমান। ইরাক, ইরান, সিরিয়া, মিশর, চীন প্রভৃতি দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে মহম্মদ বাণিজ্যের সম্প্রসারণে সাহায্য করেন এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের পরিচিতি ঘটান। ১৩২৬ থেকে ১৩২৭-এর মধ্যে মোগলগণ তরমাশিরিণের নেতৃত্বে ভারতে প্রবেশ করে সিম্মুদেশে লুঠপাট চালায় এবং মিরাট পর্যন্ত অগ্রসর হয়। সুলতানের সেনাপতি ইউসুফ বুঘরা খাঁ তাদের বিতাড়িত করতে সমর্থ হন।

মহম্মদ বিন তুঘলকের পরিকল্পনা: মৌলিক প্রতিভার অধিকারী মহম্মদ বিন তুঘলক বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। পরিকল্পনাগুলির যৌক্তিকতা নিয়ে সন্দেহ না থাকলেও বাস্তব বিচার বোধ ও তাত্ত্বিক জ্ঞানের অভাবে তা ব্যর্থ হয়।

দোয়াব অঞ্চলে কর বৃদ্ধিঃ মহম্মদ গঙ্গা ও যমুনা নদীর মধ্যবর্তী দোয়াব অঞ্চলের কৃষকদের রাজস্বের হার হঠাৎ ১০ থেকে ২০ গুণ বৃদ্ধি করেন। সম্ভবত আয় বৃদ্ধি করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। এ সময় ওই অঞ্চলে দীর্ঘকাল যাবৎ অনাবৃষ্টি চলছিল। সরকারি কর্মচারীরা কঠোরভাবে রাজস্ব ও অন্যান্য কর আদায় করার জন্য চেষ্টা করলে হতাশ কৃষকগণ জমিজমা ফেলে বনে-জঙ্গলে পালিয়ে যায়। এতে ক্রুধ হয়ে সুলতান বনজঙ্গল ঘিরে তাদের ধরে পশুর মতো হত্যা করার নির্দেশ দেন। পরে অবশ্য নিজের ভুল বুঝতে পেরে তিনি ত্রাণের ব্যবস্থা করেছিলেন।

রাজধানী স্থানান্তর: ১৩২৭-১৩২৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মহম্মদ তাঁর রাজধানী দিল্লি থেকে দাক্ষিণাত্যের দেবগিরিতে স্থানান্তরিত করেন। দেবগিরির নতুন নাম হয় দৌলতাবাদ। দিল্লি উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের নিকটে অবস্থিত হওয়ায় তা মোগলগণের নাগালের মধ্যে ছিল। তাছাড়া দেবগিরি ভারতের প্রায় মধ্যবর্তী স্থানে থাকায় সেইস থেকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর তদারকি চালানো সহজতর হত।

রাজধানী দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন: সুলতানের নির্দেশে প্রধানত আমিরশ্রেণির লোকজন পদস্থ সরকারি কর্মচারী এবং উলেমাগণ দেবগিরিতে যেতে বাধ্য হন। দিল্লি সুলতানের প্রথম রাজধানী হিসাবেই রয়ে যায়। কিন্তু দেবগিরিতে থাকতে আমির, উলেমা এবং স্বয়ং সুলতানেরই ভালো লাগছিল না। তাছাড়া দেবগিরি থেকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের দিকে নজর রাখাও কঠিন হয়ে উঠেছিল। ফলে ১৩৩১ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আবার সদলে দিল্লিতে ফিরে যান। যথেষ্ট চিন্তাভাবনা না করে এত বড়ো পরিবর্তন ঘটাতে যাওয়ার ফলেই সুলতানকে ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে হয়।

* প্রতীকী মুদ্রার প্রচলন: সুলতান ১৩২৯-৩০ খ্রিস্টাব্দে নিদর্শক বা প্রতীক মুদ্রা (Token Currency) চালু করেন। সাম্রাজ্যে রূপার অভাব দেখা দেওয়ায় এবং পারস্য, ও চীনের নিদর্শক মুদ্রার সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে সুলতান রূপার মুদ্রার সমান মূল্যবিশিষ্ট তামা বা ব্রোঞ্জের মুদ্রা চালু করেন। রূপার তুলনায় তামা বা ব্রোঞ্জের ধাতুগত মূল্য অনেক কম হওয়ায় বিদেশি বণিকেরা তা নিতে চাইত না। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্য কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। সুলতানের সতর্কতার অভাবে এই মুদ্রা ব্যাপকভাবে জাল হতে থাকে। জাল মুদ্রা ধরার কোনো ব্যকথা না করে সুলতান নিদারুণ ভুল করেছিলেন। তিনি পুনরায় রূপার মুদ্রা চালু করেন।

দিগ্বিজয়ের পরিকল্পনা: মোগল শক্তির পতনের পর মধ্য এশিয়ায় সাময়িকভাবে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্ট হলে সুলতান সেখানকার খোরাসান, ইরাক ও অক্ষুনদীর ওপারের অঞ্চল জয় করার জন্য ৩ লক্ষ ৭০ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য সংগ্রহ করেন। কিন্তু মধ্য এশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি পালটে যাওয়ায় এক বছর ধরে ওই সৈনাবাহিনী বহু ব্যয়ে পোষণ করার পর তিনি তা ভেঙে দেন।

* অভিযানে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন: মহম্মদ অবশ্য হিমালয়ের কাংড়া অঞ্চলের দুর্ভেদ্য দুর্গ, নগরকোট দখল করেছিলেন। হিমালয়ের কুমায়ুন অঞ্চলের কারাচল দখল করতে গিয়ে বর্ষার প্রকোপ, প্লেগের প্রাদুর্ভাব এবং পার্বত্য জাতির চোরাগোপ্তা আক্রমণে তাঁর প্রায় এক লক্ষ সৈন্য বিনষ্ট হয়। এই পার্বত্য অঞ্চলে সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারীরা প্রায়ই আশ্রয় পেত বলে সুলতান এটি অধিকার করতে চেয়েছিলেন।

* পরিকল্পনার ব্যর্থতা: ওপরের আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, মহম্মদের সংস্কার ও সামরিক অভিযানগুলির প্রত্যেকটির পেছনেই যুক্তি ছিল। কিন্তু তাঁর ধৈর্যহীনতা, ক্রোধপরায়ণতা, কোনো কাজে হাত দেবার আগে উপযুক্ত চিন্তাভাবনা না করার প্রবণতা, বাস্তবজ্ঞান ও সতর্কতার অভাব-তাঁর অধিকাংশ প্রয়াসকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে। এর ফলে জনগণ ও অভিজাতবর্গ তাঁর ওপর আস্থা হারায়। তাঁর ওপর অসন্তুষ্ট উলেমারাও তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে থাকে।

* বিদ্রোহ ও ফলাফল: মহম্মদের প্রায় ২৫ বছর ব্যাপী রাজত্বকালে অন্তত ২২ টিবিদ্রোহ ঘটে। সব বিদ্রোহ তিনি দমন করতে পারেননি। তাঁর জীবদ্দশাতেই দক্ষিণ ভারতে স্বাধীন হিন্দু রাজ্য বিজয়নগর (১৩৩৬) এবং মুসলিম রাজ্য বাহমনী (১৩৪৭) প্রতিষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ ভারতের আরও কিছু অঞ্চল এবং বঙ্গদেশও স্বাধীন হয়ে যায়।

মহম্মদের চরিত্র: বিচিত্র চরিত্রের অধিকারী মহম্মদ ছিলেন নানা বিদ্যায় পারদর্শী, ধর্মভীরু, দাতা, সচ্চরিত্র, ন্যায়াধীশ, দুঃসাহসী যোদ্ধা ও নবসংস্কার প্রবর্তনে আগ্রহী শাসক। এই ভালো দিকগুলি ছাড়াও তাঁর চরিত্রের যে মন্দ দিকগুলি দেখা গেছে সেগুলি হল- অতি নিষ্ঠুরতা, সমালোচনা-অসহিয়, অধৈর্য পরায়ণ, বাস্তবজ্ঞানবর্জিত, লোকচরিত্র অনভিজ্ঞ, অসম্ভব জেদি ও ক্রোধী, অসতর্ক ও খামখেয়ালিপনা। এই সমস্ত দোষগুলির জন্য ইতিহাসে তাঁকে ‘পাগলা রাজা’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

* মূল্যায়ন: বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তক মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলে সুলতানি সাম্রাজ্যের ভাঙন শুরু হয়। সিন্ধু দেশে বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে মহম্মদের মৃত্যু ঘটে। সুতরাং মুহম্মদ দিল্লির সুলতানি রাজ্যের দুর্বলতা ও পতনের জন্য অনেকটাই দায়ী ছিলেন।

ফিরোজ শাহ (১৩৫১-১৩৮৮ খ্রি.):

মহম্মদের মৃত্যুর পর তাঁর অধীনস্থ অভিজাতশ্রেণি, সেনাপতিবর্গ ও উলেমা সম্প্রদায়ের পূর্ণ সমর্থনে মহম্মদের পিতৃব্যপুত্র ফিরোজ শাহ সিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন স্বভাবে কোমল, ক্ষমাশীল, শান্তিপ্রিয় কিন্তু ধর্ম বিষয়ে অনুদার। আসলে তিনি উলেমাদের হাতে ক্রীড়নক ছিলেন।

প্রজারঞ্জক শাসক: ফিরোজ শাহ উল্লেখযোগ্য যোখাও ছিলেন না। তিনি নগরকোট দখল করেন এবং ওড়িশার রাজাকে বাধ্য করেন কর দিতে। কিন্তু দুবার চেষ্টা করেও বাংলা তিনি দখল করতে পারেন নি। বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্য অধিকার করার জন্যও তিনি প্রচেষ্টা চালান। তাঁকে প্রজারঞ্জক শাসক বলে ঐতিহাসিকরা মন্তব্য করেছেন। তিনি প্রজাদের করের বোঝা হালকা করেন ও আগেকার সুলতানের কঠোর শাস্তিব্যবস্থাও নিষিদ্ধ করেন।

* কৃষিব্যবস্থার সংস্কারসাধন: ফিরোজ কৃষির উন্নতির জন্য সেচের সুষ্ঠু ব্যকথাকরেছিলেন। তাঁর নির্দেশে বেশ কয়েকটি খাল খনন করা হয়। কথিত আছে যে, তাঁর আমলে দ্রব্যমূল্য হ্রাস পেয়েছিল এবং কৃষকদের অবস্থা উন্নত হয়েছিল।

* সামাজিক সংস্কার: ফিরোজের উদ্যোগে ফল-ফুলের বহু বাগান, বেশ কয়েকটি শহর, মাদ্রাসা ও দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপিত হয়। তিনি রাষ্ট্রীয় মরচে দরিদ্র মুসলমান কন্যাদের বিবাহের ব্যবস্থা করে দিতেন। মুসলমান বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য তিনি একটি কর্মসংস্থান কেন্দ্রও স্থাপন করেন।

* ধর্মীয় নীতি: হিন্দুপ্রধান ভারতবর্ষে কেবল মুসলিমদের স্বার্থে রাজকোশের অর্থব্যয় করা ন্যাযা তো নয়ই, প্রজ্ঞার পরিচয়ও বহন করে না। দিল্লির সুলতানদের মধ্যে ফিরোজই হিন্দু ব্রাহ্মণদের ওপরে জিজিয়া কর স্থাপন করেন। তিনি হিন্দুদের প্রকাশ্যে ধর্মাচরণ নিষিদ্ধ করে দেন। তাঁর উদ্যোগে অবশ্য কিছু সংস্কৃত গ্রন্থ ফারসি ভাষায় অনূদিত করা হয়েছিল।

জায়গির দান: ফিরোজ রাজকর্মচারী ও সৈন্যদের নগদে বেতন দেবার বদলে জায়গির দিতে শুরু করেন। এতে জায়গিরদারদের শক্তিবৃদ্ধি ঘটে ও সুলতানের ক্ষমতা ক্ষুণ্ণ হয়। সুলতান সৈন্যবিভাগে দুর্নীতি দমন করতে ব্যর্থ হন। তিনি উৎকোচ দেওয়া- নেওয়া তো বন্ধ করতে পারেননি বরং পরোক্ষভাবে তাকে উৎসাহিতই করতেন।

বন্দিদের প্রতি আচরণ: দয়ালু ফিরোজ যুদ্ধ বন্দিদের হত্যা না করে ক্রীতদাসে পরিণত করেন। এর ফলও রাজ্যের পক্ষে শুভ হয়নি। তাঁর সময় ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থারও অবসান ঘটেছিল। উলেমা-প্রভাবিত তাঁর রাষ্ট্রকে প্রকৃত ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র বলা যায়।

সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনে দায়ী: ফিরোজও মহম্মদের মতো দিল্লির সুলতানির পতনের জন্য বেশ কিছুটা দায়ী ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই সুলতানি রাজ্যের অবক্ষয় শুরু হয়। এই বংশের শেষ সুলতান মামুদ শাহের আমলে মধ্য এশিয়ার সমরকন্দের অধিপতি তৈমুরলং ভারতে এসে দিল্লি লুন্ঠন করেন (১৩৯৮)। তাঁর আক্রমণ বিল্লির সুলতানি শাসনের পতনকে ত্বরান্বিত করে তোলে। ১৪১৩-তে মামুদশাহের মৃত্যু হলে তুঘলক বংশের বদলে দিল্লিতে খিজির খাঁ সৈয়দ বংশ স্থাপন করেন। এটি ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টিকে থাকে।

■ তৈমুর লঙের ভারত আক্রমণ:

ফিরোজের মৃত্যুর পর অক্ষম ও অপদার্থ শাসকদের দুর্বলতার ফলে কেন্দ্রীয় শাসন শিখিল হয়ে এল এবং বিভিন্ন স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটল। এইভাবে সুলতানি সাম্রাজ্যের পরন যখন আসন্নপ্রায় সেই সময় সমরখন্দের দিগ্বিজয়ী মোগল বীর তৈমুরলও ভারত আক্রমণ করেছিলেন। তৈমুর ছিলেন তুর্কি। খোঁড়া ছিলেন বলে তাকে ‘লঙ’ বলা হত। ভারতের ইতিহাসে তৈমুরলও ছিলেন এক দুঃস্বপ্নের নায়ক।

* ভারত আক্রমণ: ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে তৈমুর ভারত আক্রমণ করেন। বিপুলবাহিনী নিয়ে সিন্ধু, ঝিলাম ও রাভি নদী অতিক্রম করে তিনি দিল্লির উপকণ্ঠে উপস্থিত হন। দিল্লিতে তিনি যে ‘নরমেধ যজ্ঞে’র আয়োজন করেছিলেন ইতিহাসে তার নজীর বিরল। দিল্লি আক্রমণ সমাধা হলে তৈমুর পাঞ্জাব শাসনের জন্য এক প্রতিনিধি রেখে অসংখ্য বন্দী ও অগণিত ধনরাশি নিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

* তৈমুরের আক্রমণের ফলাফল: তৈমুরের নৃশংস আক্রমণের ফলে দিল্লি ও উত্তর ভারতের এক বিস্তৃত অঞ্চল শ্মশানে পরিণত হয়েছিল। দিল্লি প্রবেশের প্রাক্কালে তিনি এক লক্ষ হিন্দু বন্দিকে হত্যা করেছিলেন যাতে তারা বিদ্রোহী হয়ে প্রতিরোধকারীদের সাহায্য করতে না পারে। অন্যদিকে তৈমুর যে বিশাল সম্পদ অপহরণ করেন তার প্রতিঘাতে ভারতে তীব্র আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছিল। অত্যাচারী অভিযানকারী চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে এল দুর্ভিক্ষ ও মহামারি। তাছাড়া, তৈমুরের আক্রমণ দিল্লির তুঘলক বংশের পতন ঘটাল এবং তৈমুরের ভারতস্থিত শাসনকর্তা খিজির খান দিল্লিতে সৈয়দ রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করলেন।

সৈয়দ বংশ (১৪১৪-১৪৫১ খ্রিঃ):

সৈয়দ বংশ প্রায় ৩৭ বছর রাজত্ব করেন। দিল্লির সৈয়দ বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খিজির খাঁ। তাঁর পুত্র মুবারক শাহ সিংহাসনে বসেন। মুবারক খাঁ-এর মৃত্যুর পর মহম্মদ শাহ সিংহাসনে বসেন। ১৪৪৫ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন আলম শাহ তাঁর উত্তরাধিকারী হন। তিনি ছিলেন সৈয়দ বংশের শেষ শাসক।

লোদি বংশ (১৪৫১-১৫২৬ খ্রিঃ):

১৪৫১খ্রিস্টাব্দে আফগান জাতীয় বুহলুল লোদি দিল্লি দখল করে লোদি বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। এই বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান সিকন্দর লোদি (১৪৮৯-১৫১৭ খ্রিস্টাব্দ) বাংলার সীমান্ত পর্যন্ত রাজ্যবিস্তার করেন। তাঁর রাজত্বে শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজ করত। লোদি বংশের শেষ সুলতান ইব্রাহিম লোদিকে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে (১৫২৬) পরাজিত ও নিহত করে কাবুলের মোগল অধিপতি বাবর দিল্লি দখল করে সেখানে মোগল বংশ স্থাপন করেন।

দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের কারণ:

১২০৬ খ্রিস্টাব্দে কুতুবউদ্দিন আইবক দিল্লিতে সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে সে সাম্রাজ্যের বিনাশ ঘটে। বিভিন্ন কারণে এই সুলতানি শাসনের পতন ঘটে। কারণগুলি হল-*

(১) শাসকদের দূর্বলতা: সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ ছিল শাসকদের দুর্বলতা। মধ্যযুগীয় শাসনব্যবস্থার ভিত্তি ছিল সুলতানের যোগ্যতা ও ব্যক্তিত্বের উপর নির্ভরশীল। সুলতানি শাসনের শেষের দিকে শাসকদের এ বিষয়ে দুর্বলতা দেখা দেয়।

* (২) জনবিচ্ছিন্নতা: দিল্লির সুলতানরা জনগণের সহিত কোনো যোগাযোগ রাখতেন না। তাঁরা ছিলেন জনবিচ্ছিন্ন। জনগণ হতে বিচ্ছিন্ন রাজশক্তির স্থায়িত্ব দীর্ঘ হয় না।

* (৩) অর্থনৈতিক নীতি: সুলতানি রাজস্বনীতি ত্রুটিপূর্ণ ছিল। সেনাবাহিনীর ব্যয়ের জন্য রাজস্ব আদায়ের প্রয়োজন ছিল। অতিরিক্ত কর বসানো হয় জনগণের উপর। ফলে আর্থিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।

* (৪) গোঁড়া ধর্মীয় নীতি: দিল্লির সুলতানরা শরিয়তের বিধান মেনে দেশ শাসন করতেন। হিন্দুদের ওপর জিজিয়া কর স্থাপন ও মন্দির ধ্বংস করার ঘটনায় হিন্দুরা সুলতানি শাসনের উপর অসন্তুষ্ট ছিল।

☆(৫) অভিজাত শ্রেণির অধঃপতন: অভিজাত শ্রেণিই ছিল সুলতানি সাম্রাজ্যেরস্তস্তস্বরূপ। তাদের নৈতিক অধঃপতন, বিলাস-বাসন ও ক্ষমতার লোভ শাসন ব্যকথায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল।

☆(৬) দাস নিয়োগে অনিয়ম: দাস নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও ব্যক্তিগত প্রতিভারওপর জোর দেওয়া হলেও ফিরোজ তুঘলকের সময় এ নীতি পরিত্যক্ত হয়। তাঁর চল্লিশ হাজার ক্রীতদাসের মধ্যে অধিকাংশ ছিল অযোগ্য ও অপ্রয়োজনীয়। অর্থব্যয় ছাড়া এদেরদ্বারা কিছুই লাভ হয় নি।

* (৭) বৈদেশিক আক্রমণ: বৈদেশিক শত্রুর আক্রমণে সুলতানি সাম্রাজ্যের পতন নিশ্চিত হয়ে উঠে। মোগলরা বারবার সীমান্ত অঞ্চল আক্রমণ করে। ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে তৈমুর লঙ ভারত আক্রমণ করে দিল্লি লুণ্ঠন করে ধন সম্পদ নিয়ে দেশে ফিরে যান। তাঁর আক্রমণে দেশব্যাপী অরাজকতার সৃষ্টি হয়। সর্বশেষে ক্ষীয়মান সুলতানি সাম্রাজ্যের উপর চরম আঘাত হানলেন বাবর। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে বাবরের আক্রমণে ইব্রাহিম লোদির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সুলতানি শাসনের অবসান ঘটে। তার উপর গড়ে ওঠে মোগল সাম্রাজ্য।

কয়েকটি আঞ্চলিক রাজ্য

বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমল: মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক শক্তির উত্থান হয়। পূর্ব ভারতের বাংলাদেশে ইলিয়াসশাহী ও হুসেনশাহীবংশ এবং দাক্ষিণাত্যে বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্য ছিল ওই সব আঞ্চলিক শন্তির অন্যতম। ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ২০০ বছর ইলিয়াস শাহী ও হুসেনশাহী বংশের রাজত্বকালকে বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমল বলা হয়।

* ইলিয়াস শাহী বংশ: ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ লক্ষ্মণাবতীর সিংহাসনে বসে বাংলার ‘ইলিয়াসশাহী’ শাসন শুরু করেন। তিনি ত্রিহূত, ওড়িশা, সোনর গাঁও দখল করেন। ফিরোজ শাহ তুঘলক তাঁর ক্ষমতা খর্ব করতে সচেষ্ট হলেও ব্যর্থ হন (১৩৫৩ খ্রিঃ)। ১৩৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর সিকান্দার শাহ বাংলার সিংহাসনে বসেন। তাঁর মৃত্যুর পর গিয়াসউদ্দিন আজমশাহ ১৪০৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। কিন্তু পরবর্তী শাসকদের দুর্বলতার সুযোগ ভাতুরিয়ার জমিদার গণেশ বাংলার সিংহাসন দখল করেন। ইলিয়াস শাহী বংশের শেষ সুলতান নাসিরউদ্দিন ১৪৪২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।

বাহমনী রাজ্য: ১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যে হাসান বা আলাউদ্দিন বাহমন শাহ ‘বাহমনী’ রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বাহমনী রাজ্যকে- গুলবর্গা, দৌলতাবাদ, বেরার ও বিদর এই চার ভাগে ভাগ করেন। তাঁর সাম্রাজ্য উত্তরে পেনগঙ্গা থেকে দক্ষিণে কুয়া নদী এবং পূর্বে ভোনগির থেকে পশ্চিমে দৌলতাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ সুলতান ছিলেন ফিরোজশাহ। তাঁর পর রাজ্যের সংহতি বিনষ্ট হয় এবং আহম্মদনগর, বিজাপুর, গোলকুন্ডা, বেরার ও বিদর নামে নতুন পাঁচটি রাজ্যের জন্ম হয়।

* বিজয়নগর রাজ্য: মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে তুঙ্গভদ্রা নদীর দক্ষিণ উপকূলে সঙ্গাম নামে এক ব্যক্তির পাঁচ ছেলে ১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে বিজয়নগর রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন। হরিহর ও বুক্কা ছিলেন এই রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। মোট চারটি রাজবংশ বিজয়নগর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়। সঙ্গম বংশ, সালুভ বংশ, তুলুব বংশ এবং আরবিডু বংশ। এই রাজ্যের উল্লেখযোগ্য রাজারা হলেন-প্রথম দেবরায়, দ্বিতীয় দেবরায়, কৃরদেব রায় প্রমুখ।