সুলতানি যুগের সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক ইতিহাস

☆ সুলতানি যুগের সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক ইতিহাস (Sulatani yuger sanksipta rajanaitik itihas)

∎ কুতুবউদ্দিন আইবক (১২০৬-১২১০খ্রি.):

সুলতানি আমলের সূত্রপাত: তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে জয়লাভের পর মহম্মদ ঘুরি গজনিতে ফিরে যান। যাবার আগে তিনি তাঁর সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবককে ভারতে বিজিত রাজ্যগুলির শাসনভার দিয়ে যান। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ঘুরির মৃত্যু হলে কুতুবউদ্দিন দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন।

দাস বংশের প্রতিষ্ঠা: ১২০৮ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ঘুরির উত্তরাধিকারীর কাছ থেকেতিনি দাসত্ব থেকে মুক্তি পান। তিনি দিল্লিতে যে নতুন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন তা দাস বংশ নামে পরিচিত।

প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাজয়: মহম্মদ ঘুরির এক সেনাপতি তাজউদ্দিন ইলদুজ গজনিঅধিকার করে ঘুরির ভারতীয় সাম্রাজ্য অধিকার করার চেষ্টা করলে কুতুবউদ্দিনের হাতে তার পরাজয় ঘটে। গজনি রাজ্যও কুতুবউদ্দিন অধিকার করেন কিন্তু মাত্র ৪০ দিনের মাথায় তিনি গজনি ত্যাগ করে চলে আসতে বাধ্য হন। ঘুরির আর এক সেনাপতি নাসিরুদ্দিন কুবাচাও দিল্লি দখলে আগ্রহী দেখে কুতুবউদ্দিন নিজ ভগিনীর সঙ্গে বিবাহ দিয়ে নিরস্ত করেন। তারপর প্রায় সমগ্র উত্তরভারত জুড়ে তিনি সুলতানি সাম্রাজ্যের পত্তন করেন।

* শাসক হিসাবে কৃতিত্ব: কুতুবউদ্দিন শাসনকার্যে তেমন অভিনবত্ব প্রদর্শন করতে না পারলেও স্বাধীন সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কুতুবউদ্দিন মাত্র চার বছরকাল রাজত্ব করেছিলেন। এই স্বল্প সময়ে তিনি ভারতে একটি সার্বভৌম মুসলমান শাসনের রূপরেখা রচনা করে যান। তাঁর আমলে দিল্লি, কনৌজ, গোয়ালিয়র, রণথোস্তুর প্রভৃতি স্থান তুর্কি সাম্রাজ্যের অধিকারভুক্ত হয়। তিনি বাংলায় খলজি মালিকদের বিদ্রোহও দমন করেন। কুতুবউদ্দিনের সময় গজনির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ায় দিল্লির সুলতানি রাজ্য মধ্য এশিয়ার রাজনীতি থেকে মুক্ত হয়ে নিজের বিকাশের দিকে মন দিতে পারে।

* মূল্যায়ন: কুতুবউদ্দিন প্রথম শ্রেণির সেনাপতি ও দক্ষ কূটনীতিবিদ ছিলেন। তিনি অত্যন্ত উদার ও দানশীল নরপতি ছিলেন। তাঁর দানধ‍্যানের জন্য তাঁকে ‘লাখবন্ধু’ বলা হত। তিনি স্থাপত্য শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁরই রাজত্বকালে দিল্লিতে কুতুবমিনার-এর নির্মাণকার্য শুরু হয়েছিল। ১২১০ খ্রিস্টাব্দে চৌগান বা পোলো খেলার সময় ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

■ ইলতুৎমিস (১২১১-১২৩৬ খ্রি.):

কুতুবউদ্দিনের মৃত্যুর পর আরাম শাহ দিল্লির সিংহাসন আরোহণ করেন। কিন্তু আরাম শাহের অকর্মণ্যতায় বিরক্ত হয়ে দিল্লির আমিরগণ কুতুবউদ্দিনের জামাতা বদাউনের শাসনকর্তা ইলতুৎমিসকে রাজ্যভার গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন।

* সিংহাসন আরোহণ: ইলতুৎমিস সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে দিল্লি অভিযান করেন। আরাম শাহকে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করে তিনি দিল্লির সিংহাসন দখল করেন এবংনিজেকে সুলতান বলে ঘোষণা করেন (১২১১ খ্রিঃ)।

অভ্যন্তরীণ সমস্যার সম্মুখীন: সিংহাসনে আরোহণের অল্পকালের মধ্যেই ইলতুৎমিসকে কয়েকটি আভ্যন্তরীণ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সেগুলি হল উত্তর ভারতের সামন্ত রাজাদের বিদ্রোহ, নাসিরুদ্দিন কুবাচার বৈরিতা, তাজউদ্দিন ইলদিজ-এর সিংহাসন দাবি এবং বাংলার শাসনকর্তার স্বাধীনতা ঘোষণা।

* বিদ্রোহ দমন: ইলতুৎমিস প্রথমে উত্তর ভারতের সামন্ত নায়কদের বিদ্রোহ দমন করে বদাউন, অযোধ্যা ও বারাণসীতে নিজ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করেন। অতঃপর তরাইনের মুখে ইলদিজকে পরাজিত এবং বন্দী করেন। তারপর মূলতানের শাসনকর্তা নাসিরুদ্দিন কুবাচা লাহোর অধিকার করলে ইলতুৎমিস তাঁকে পরাজিত করে লাহোর উদ্ধার করেন।

১২১৫ খ্রিস্টাব্দে ইলতুৎমিস বাংলার স্বাধীন সুলতান গিয়াসউদ্দিন খলজির বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেন। গিয়াসুদ্দিন বিনা যুদ্ধে ইলতুৎমিসের বশ্যতা স্বীকার করলেন।

সার্বভৌম মুসলিম রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা: পরবর্তীকালে বাংলাদেশে পুনঃ পুনঃ বিদ্রোহ হলে ইলতুৎমিস স্বয়ং বাংলাদেশে অভিযান করে বাংলাকে দিল্লির অধিকারভুক্ত করেন। এছাড়া তিনি রণখোস্তর ও গোয়ালিয়র অধিকার করে উত্তর ভারতে নিজ আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। ভারতে সুলতানি সাম্রাজ্য সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। এজন্য ইলতুৎমিসকে ভারতে সার্বভৌম মুসলিম রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।

চিলিজ খাঁ-র ভারত আক্রমণ: ইলতুৎমিসের রাজত্বকালের মধ্য এশিয়ার দুর্ধর্ষ মোঙ্গল নেতা চিঙ্গিজ খাঁ খাওয়ারিজমের রাজধানী খিবা আক্রমণ করেন এবং খিবার সুলতান জালালউদ্দিনকে অনুসরণ করে সিদ্ধউপত্যকায় এসে উপস্থিত হন। জালালউদ্দিন ইলতুৎমিসের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করলে ইলতুৎমিস তা দিতে অস্বীকৃত হন। ফলে জালালউদ্দিন সিন্ধুদেশের বহু স্থান ধ্বংস করে পারস্যে পলায়ন করেন। চিঙ্গিজ খাঁ তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করলে ভারতবর্ষ বড় রকমের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পায়। এইভাবেই ইলতুৎমিস তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতার দ্বারা ভারতে তাঁর সাম্রাজ্যকে রক্ষা করেন।

সুসংহত সুলতানি সাম্রাজ্য গঠন: ইলতুৎমিস নিজ বুদ্ধি ও বাহুবলে শুধু যে সাম্রাজ্যের সংহতি রক্ষা করেছিলেন তাই নয়, এই সাম্রাজ্যের পরিধিও তিনি বিস্তৃত করেছিলেন। তাঁর মতো যোগ্য ব্যক্তি দিল্লির সিংহাসনে না বসলে খুব সম্ভবত সুসংবধ ও সুবিস্তৃত সুলতানি সাম্রাজ্য গড়ে উঠত না।

উপাধি লাভ: ইলতুৎমিসের এই কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ মুসলমান জগতের ধর্মগুরু বাগদাদের খলিফা আল মুসতানসির বিল্লাহ ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে ‘সুলতান-ই-আজম’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এতে তাঁর মর্যাদা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। খলিফার প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ইলতুৎমিস তাঁর মুদ্রায় নিজেকে খলিফার অনুগত সেনাপতি রূপে ব্যক্ত করেন।

* বিদ্যোৎসাহিতা: সমকালীন ঐতিহাসিক মিনহাজউদ্দিন ইলতুৎমিসের উদারতা বিদ্যোৎসাহিতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি সাহিত্য ও শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। দিল্লির একাধিক মসজিদ, মাদ্রাসা ও মিনারগুলি তাঁর আমলে নির্মিত হয়। সুলতানি আমলের স্থাপত্য কীর্তির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন কুতুবমিনারের নির্মাণকার্য তাঁর আমলেই শেষ হয়। বিখ্যাত মুসলিম সন্ত খাজা কুতুবউদ্দিন বস্তিয়ার কাকির সম্মানে এই স্মৃতি সৌধটি নির্মিত হয়েছিল।

চল্লিশের চক্র: ইলতুৎমিসের রাজত্বকালে ৪০ জন সম্ভ্রান্ত তুর্কি আমির অত্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে। এদের চিহলগনি বা চল্লিশের চক্র নামে অভিহিত করা হত। পরবর্তীকালে এরা সুলতানদের সিংহাসনে বসা বা পদচ্যুত করা এবং সুলতানের নীতি নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে নিজেদের ক্ষমতাকে কাজে লাগাত।

কৃতিত্ব: ইলতুৎমিস গুণীর সমাদর করতেন। বহু বিদ্বান ও গুণী ব্যক্তি তাঁর রাজসভা অলংকৃত করেছিলেন। ইলতুৎমিসই সম্ভবত ভারতে প্রথম আরবি ভাষা ও হরফে নির্মিত মুদ্রার প্রচলন করেন। মুদ্রাগুলি ছিল রৌপানির্মিত। এক একটি মুদ্রার ওজন ছিল ১৭৫ গ্রাম। এডওয়ার্ড টমাস-এর মতে ইলতুৎমিসের সময় থেকে প্রকৃতপক্ষে দিল্লিতে বৈধ সুলতানি রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন হয়। এভাবে সবদিক দিয়েই ইলতুৎমিস দিল্লির রাজদরবারকে মুসলমান জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সভ্যতাকেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনিই ছিলেন দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা।

ইলতুৎমিসের মৃত্যু: ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে ইলতুৎমিসের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর অলস ও অকর্মণ্য পুত্রদের জায়গায় গুণবতী কন্যা রাজিয়াকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারিণী মনোনীত করে গিয়েছিলেন।

■ সুলতানা রাজিয়া (১২৩৬-১২৪০ খ্রি.):

সিংহাসন লাভ: ইলতুৎমিস তাঁর কন্যা রাজিয়া সুলতানাকে সিংহাসনের জন্য মনোনীত করে যান। কিন্তু স্ত্রীলোকের সিংহাসনে আরোহণ ইসলাম-এর পরিপন্থী বিবেচনা করে আমির-ওমরাহগণ ইলতুৎমিসের পুত্র রুকুনউদ্দিন ফিরোজকে দিল্লির সিংহাসনে বসান। কিন্তু তাঁর অযোগ্যতার দরুন তিনি অচিরেই সিংহাসনচ্যুত হন এবং রাজিয়া দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। রাজিয়াই একমাত্র মুসলিম রমণী, যিনি দিল্লির সিংহাসনে আসীন ছিলেন।

বিদ্রোহের সূচনা: রাজিয়া সিংহাসনে অধিষ্ঠিতা হবার পরেই বেশ কয়েকটি প্রদেশ বিদ্রোহ ঘোষণা করলে সুলতানা ভেদনীতি আশ্রয় করে তাদের বিদ্রোহগুলি দমন করতে সক্ষম হন। উদ্ধত তুর্কি আমিরদের আধিপত্য খর্ব করার জন্য রাজিয়া অ-তুর্কিদের শাসনবিভাগের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত করেন। রাজিয়া পর্দাপ্রথা না মেনে পুরুষের বেশে দরবার পরিচালনা করতেন। এই কারণে রাজিয়া সুলতানা গোঁড়া উলেমারা ও তুর্কি আমিরবর্গ অত্যন্ত ক্ষোভ প্রকাশ করে। ফলে রাজ্যে ব্যাপক বিদ্রোহের সূচনা হয়।

আমিরগণের চক্রান্ত: রাজিয়া সুলতানা তুর্কি আমিরদের ঘৃণ্য চক্রান্তে বন্দিনি হন। এই সুযোগে ইলতুৎমিসের অপর পুত্র বহরাম শাহকে আমিরেরা সিংহাসনে বসায়। কূটকৌশলী রাজিয়া অন্যতম বিদ্রোহী নেতা ভাতিন্দার শাসনকর্তা আলতুনিয়াকে বিবাহ করে দিল্লির দিকে সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে যান। কিন্তু বহরাম শাহের সেনাদল তাঁদের পরাজিত করে। যুগক্ষেত্র থেকে রাজিয়া ও আলতুনিয়া পলায়ন করেন কিন্তু পথিমধ্যে হিন্দু উপজাতির লোকেরা তাঁদের হত্যা করে।

রাজিয়ার পতন: অসাধারণ ব্যস্তিত্ব, মনোবল ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও রাজিয়া প্রধানত তুর্কি আমিরবর্গের বিরোধিতার জন্যই বেশিদিন রাজ্যশাসন করতে পারেননি ও তাঁর পতন হয়। এর পরে বলবন তুর্কিদের একাধিপত্য খর্ব করে রাজিয়ার অসমাপ্ত কাজগুলি সমাপ্ত করেন।

■ ইলতুৎমিসের দুর্বল বংশধরগণ :

বহরাম শাহ (১২৪০-১২৪২ খ্রিস্টাব্দ): ১২৪০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৪২ খ্রিস্টাব্দঅবধি বহরাম শাহ রাজত্ব করেন। তিনি বিরোধী সন্দেহ করে বহু নেতৃস্থানীয় তুর্কিকে হত্যা করায় তুর্কি আমিরবর্গ সংঘবন্ধ হয়ে তাঁর প্রাণহরণ করে।

* আলাউদ্দিন মাসুদ শাহ (১২৪২-১২৪৬ খ্রিস্টাব্দ): বহরাম সাহের পরবর্তী সুলতান ছিলেন ইলতুৎমিসের পৌত্র আলাউদ্দিন মাসুদ শাহ (১২৪২-১২৪৬ খ্রিস্টাব্দ)। তাঁকে নামেমাত্র শাসক রেখে প্রকৃত শাসনকার্য পরিচালনা করত চল্লিশের চক্র। নিজের রণনৈপুণ্য কূটবুদ্ধি ও শাসনসংক্রান্ত দক্ষতার বিষয়ে বাহাউদ্দিন বলবন নামে এক প্রভাবশালী তুর্কি আমির চল্লিশের চক্রের অন্যতম প্রধান নেতা হয়ে দাঁড়ান। শেষ পর্যন্ত তাঁরই নেতৃত্বে চল্লিশের চক্র কর্তৃক আলাউদ্দিন মাসুদকে পদচ্যুত করে ইলতুৎমিসের অপর পুত্র নাসিরুদ্দিন মামুদকে সিংহাসনে মনোনীত করে।

নাসিরুদ্দিন মামুদ (১২৪৬-১২৬৬ খ্রি.): নাসিরুদ্দিন মামুদ স্বভাবে ছিলেন অত্যন্তনিরীহ ও শান্তিপ্রিয় ব্যক্তি। তাঁর সুদীর্ঘ রাজত্বকালে চল্লিশের চক্রের নেতা বলবন কার্যক্ষেত্রে সমস্ত শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেন। তিনি রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহকে দমন করে তুর্কি আমিরবর্গকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন। তার সঙ্গে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করে তিনি নিজেকে যোগ্য শাসক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। সুলতানের সঙ্গে তাঁর কন্যার বিবাহই একথা প্রমাণ করে। কয়েকজন বিশিষ্ট ঐতিহাসিকের মত অনুসারে বলবন বিষ প্রয়োগ করে তরুণ সুলতানকে হত্যা করে দিল্লির মসনদ দখল করেন। সিংহাসনে বসে তিনি গিয়াসুদ্দিন বলবন নামে পরিচিতি লাভ করেন।

■ গিয়াসুদ্দিন বলবন (১২৬৬-১২৮৭ খ্রি.):

অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা: বলবন সিংহাসনে বসে সর্বপ্রথম অভ্যন্তরীণ শান্তি- শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। দিল্লির নিকটস্থ মেওয়াট অঞ্চলের (আলোয়ার- ভরতপুর) রাজপুতগণের লুঠপাটের ফলে ব্যাবসাবাণিজ্য বন্ধ হবার উপক্রম হয় এবং রাজপথে চলাচলও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। বলবন চরম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে মেওয়াটীদের দমন করেন।

বিদ্রোহ দমন: বলবন দোয়াব অঞ্চলের হিন্দু কৃষকদের বিদ্রোহ দমন করে বাংলা ও দিল্লির মধ্যবর্তী পথ নিরাপদ করেন। রোহিলখণ্ড অঞ্চলের হিন্দুদের বিদ্রোহও তিনি চূর্ণ করে দেন। এরপর বাংলার শাসনকর্তা তুমিল খাঁর বিদ্রোহ দমন করতে সুলতানের সৈন্যবাহিনী দু-বার ব্যর্থ হয়। তৃতীয় বারের চেষ্টায় স্বয়ং সুলতান তাঁকে পরাজিত ও হত্যা করেন। বলবনের কনিষ্ঠ পুত্র বুঘরা খাঁ বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন।

* সুলতানের মর্যাদা বৃদ্ধি: বলবন সুলতানের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য নিজেকে পারস্যের এক অতি বংশের সন্তান ঈশ্বরের প্রতিনিধি ও ছায়া বলে দাবি করেন। তাঁর মতে, তিনি তাঁর কার্যাবলির জন্য কারও কাছে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নন। তিনি জানিয়ে দেন যে, সুলতান জনগণ বা অভিজাতদের ইচ্ছায় সিংহাসনে বসেন নি। ঈশ্বরের ইচ্ছা ও আদেশ অনুসারেই তিনি সুলতান। তাই সুলতান একক ও অদ্বিতীয়।

রাজদরবারের নিয়মকানুন: বলবনের প্রাসাদ ও দরবার জাঁকজমকপূর্ণ ছিল। বংশকৌলীন্য বিচার না করে তাঁর আমলে কাউকে কোনো উচ্চ সরকারি পদে নিয়োগ করা হত না। দরবারে তিনি কিছু আদব-কায়দা চালু করেন। দরবারে লঘু চপলতা, হাসা-পরিহাস কঠোরভাবে নিষিধ করা হয়। সাধারণ মানুষের সাথে সুলতানের বাক্যালাপ তিনি পরিহার করেন। পারসিক রীতি অনুযায়ী সুলতানের নিকটে আসা লোকজনদের নতজানু হয়ে প্রণাম (সিজদা) এবং সিংহাসনের পদচুম্বন (পাইবস) করতে হত।

গিয়াসুদ্দিন বলবন

সামরিক সংস্কার: বলবন সুলতানের শক্তির প্রধান উৎস সৈন্যবাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করেন এবং সৈন্যদের বেতনও বাড়িয়ে দেন। ইস্তাদারগণ অযোগ্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ায় বলবন ইত্তাদারদের হাত থেকে সমস্ত ইস্তা (প্রদত্ত ক্ষমতা) কেড়ে নেবার ও তরুণ ইস্তাদারদের সৈন্যবাহিনীতে সরাসরি নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত করেও শেষ পর্যন্ত প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়ে তা প্রত্যাহার করে নেন। উদ্ধত ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী আমিরদের দমন করার জন্য তিনি ‘তুর্কান-ই-চহেলগান’ ভেঙে দেন।

বিচার ব্যবস্থা: ন্যায় ও নিরপেক্ষ বিচারের নামে বহু গুরুত্বপূর্ণ অভিজাতকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেন। নিজ গৃহভৃত্যকে হত্যা করার অপরাধে বলবন বদাউনের শাসক মালিক বারবককে প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করেন। মদ্যপ অকথায় এক ব্যক্তিকে হত্যার অপরাধে অযোধ্যার শাসক হায়বৎ খাঁ’কে ৫০০ বেত্রাঘাত ও নিহত ব্যপ্তির স্ত্রীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার নির্দেশ দেন। সামান-সুমানের গর্ভনর ও তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র শের খাঁ-র ক্ষমতাবৃদ্ধিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন।

আমির-ওমরাহদের ক্ষমতা হ্রাস: অভিজাতদের বিশেষ অধিকার তিনি নাকচ করেন দেন। বলবন গুপ্তচরদের সাহায্যে তুর্কি আমিরদের অপরাধ জেনে নিয়ে ন্যায় বিচারের ভাণ করে তাদের কঠোর শাস্তি দিতেন। নবীন তুর্কিদের আমির-পদে উন্নীত করে ‘চল্লিশ জন আমিরের’ মর্যাদায় আঘাত করেন। যেসব আমির জায়গির ভোগ করতেন, তাদের সম্বন্ধেও তদন্তের নির্দেশ দেন। এইভাবে আমির-ওমরাহদের উপর সুলতানের কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করেন।

মোঙ্গল আক্রমণ: বলবনের আমলে ঘন ঘন মোঙ্গল আক্রমণ ঘটতে থাকায় বলবন রাজ্যবিস্তার না করে তাদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য নানা ব্যকথা গ্রহণ করেন। মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে তাঁর প্রিয় পুত্র মহম্মদ প্রাণ হারান। প্রিয় পুত্রের অকাল মৃত্যুশোক সহ্য করতে না পেরে সুলতান শীঘ্রই প্রাণত্যাগ করেন।

* কৃতিত্ব: বলবন ছিলেন প্রথমশ্রেণির যোদ্ধা। সুদক্ষ প্রশাসক দূরদর্শী রাষ্ট্রনীতিবিদ এবং বিদ্বজ্জনের পৃষ্ঠপোষক হলেও তিনি ছিলেন অতি মাত্রায় নিষ্ঠুর, অনুদার, সন্দেহপ্রবণ এবং হিন্দু ও হিন্দুস্তানি মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন। তিনি সুযোগ্য তুর্কি আমিরদের মর্যাদা বিনষ্ট করে এবং তাদের এক বড়ো অংশকে হত্যা করে যে সংকটের সৃষ্টি করেছিলেন তা খলজিদের ক্ষমতা দখলে অনেকটাই সাহায্য করেছিল। সবশেষে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ‘ভারতের তোতাপাখি’ বলে পরিচিত বিখ্যাত কবি, সংগীতজ্ঞ ও ঐতিহাসিক, ভারতপ্রেমী আমির খসরু বলবনের সভাসদ ছিলেন।